কৃশানু ঘোষ, কলকাতাঃ সময়টা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। শীতকালে অদ্ভুতভাবে হঠাৎই গলে পড়ে নন্দা দেবীর হিমবাহ। যা উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার রাইনি গ্রামে আকস্মিকভাবে সৃষ্টি করে ভয়াবহ বন্যা। নিহত হন প্রায় ৮০ জন, নিখোঁজ হন ১২৪ জন, এবং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
এরপর গত ৫ বছরে উত্তরাখণ্ডে এমন কয়েক হাজার ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে যেমন মৃত্যু হয়েছে একাধিক মানুষের, তেমনই ভেসে গিয়েছে বাড়ি-ঘর সহ একাধিক এলাকা। কিন্তু এর কারণটা কী? অনেকেই এর পিছনে হয়তো পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন তত্ত্ব দাগিয়ে দেবেন। অনেকেই আবার বলবেন পাহাড়ে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। কিন্তু, জানলে অবাক হবেন, আদতে এই সমস্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পিছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (America) একটি ডিভাইস। যা প্রায় ৫০ বছর আগে ভারতের মাটিতে বসিয়েছিল আমেরিকা, যার ফলে দ্রুত গলছে তুষার, ঘটছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ধামাচাপা দেওয়া শত চেষ্টা করলেও, ধীরে ধীরে সেই ঘটনার প্রমাণ এখন দিচ্ছে প্রকৃতি নিজে থেকেই! চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ঘটনা সম্পর্কে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ডিভাইস ডেকে আনছে সর্বনাশ!
সময়টা ১৯৬০-এর দশক। সারা বিশ্বে তখন ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতি। একদিকে বিশ্বের সুপারপাওয়ার হওয়ার জন্য ব্রিটেন আর সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে চলছে পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। আর অন্যদিকে ১৯৬২ সালে, ভারত-চিন যুদ্ধের পর চিনকে নিয়ে অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে ওঠে ভারত।
এরপর ১৯৬৪ সালে, হঠাৎ করেই পরমাণু পরীক্ষা করে চিন। আর এক পরমাণু শক্তির উত্থান হতে পারে ভেবে আরও সজাগ হয়ে ওঠে আমেরিকা এবং CIA। ভয় পেতে থাকে – আরেক পরমাণু শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে হাত মিলিয়ে নেবে না তো চিন? মিলিয়ে নিলে কীভাবে একসাথে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তারা? পাশাপাশি এই পরমাণু পরীক্ষা বিচলিত করে ভারতকেও।
ফলত এবার চিনের পরমাণু কার্যকলাপ ট্র্যাক করার সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা, আর দায়িত্ব দেওয়া হয় আমেরিকার এয়ার ফোর্সের জেনারেল কার্টিস লিমে। যিনি হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করার পিছনে ছিলেন।
কিন্তু, কীভাবে এই কাজ করবেন লিমে?
কার্টিস লিমের ঘনিষ্ঠ পর্বতারোহী বন্ধু ব্যারি বিশপের সঙ্গে আলোচনা করে CIA। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মাউন্ট এভারেস্টে একটি স্পাই ডিভাইস বসানোর। তবে, এই প্ল্যানের দুটি সমস্যা ছিল — এক। এভারেস্ট চিন সীমান্তের খুব কাছে, আর দুই। চিন সহজেই ডিভাইসটি চুরি করতে পারে।
তাই বিশপ ভারতের দিকের কয়েকটি উঁচু পর্বত বেছে নেন, যেখান থেকে চিনকে স্পষ্ট দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় নন্দা দেবীকে — যেখানে ওঠা তুলনামূলক সহজ, কম পরিচিত, আর সেখান থেকে চিনের ওপর নজর রাখাও সম্ভব। আর এরপর ১৯৬৫ সালে একটি গোপন অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত্র নেয় মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (CIA) এবং ভারতের গোয়েন্দা ব্যুরো (IB)।
শুরু হল মিশন!
এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল তিব্বত সীমান্তের কাছে ২৫,৬৪৬ ফুট উঁচু নন্দা দেবী শৃঙ্গে “গুরু রিনপোচে” নামে একটি রেডিওআইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর (RTG) বসানো, যা চীনের পারমাণবিক পরীক্ষার সংকেত সনাক্ত ও নথিভুক্ত করবে। এই বিশেষ RTG-র ওজন ছিল প্রায় ৫০ কিলোগ্রাম এবং যা বছরের পর বছর ধরে কোনও রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই চলবে।
মার্কিন পর্বতারোহী, গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ভারতীয় পক্ষ থেকে এই মিশনে নেতৃত্ব দেন নৌবাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন মোহন সিং কোহলি। যিনি আবার প্রথম দ্রুততম এভারেস্ট জয়ী ছিলেন।
এরপর ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। দলটি নন্দা দেবীর বেস ক্যাম্পে পৌঁছায়, কিন্তু প্রবল তুষারঝড়ে ২৪,০০০ ফুট পর্যন্ত উঠেই থেমে যায়। প্রাণঘাতী ঝুঁকি দেখে কোহলি সিদ্ধান্ত নেন ডিভাইসটি সেখানেই রেখে ফিরে আসার। পরিকল্পনা ছিল আবহাওয়া শান্ত হলে মিশন পুনরায় শুরু হবে, কিন্তু তীব্র শীতে তা আর সম্ভব হয়নি।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ১৯৬৬ সালে মিশন পুনরায় শুরু হয়, কিন্তু ফিরে গিয়ে ডিভাইসটি আর পাওয়া যায় না। টানা তিন বছর ধরে একাধিক অনুসন্ধান অভিযান চালিয়েও সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কেন মনে করা হচ্ছে এই ডিভাইসের ফলে গলছে বরফ?
দুই বছর পর, ১৯৬৭ সালে CIA নতুন একটি মিশন করে। নন্দা কোট পর্বতে বসানো হয় আরেকটি RTG ডিভাইস। সেটি প্রথমে সফলভাবে সিগন্যাল পাঠালেও, কিছুদিনের মধ্যেই সিগন্যাল পাঠানো বন্ধ করে দেয়। অনুসন্ধান দল গিয়ে দেখে, প্লুটোনিয়াম কোরের তীব্র তাপে ডিভাইসটি বরফের ৮ ফুট নিচে গলে গেছে। যার ফলে সেটি থেকে সিগন্যাল আসছিল না। পরে সেটিকে উদ্ধার করে নিস্ক্রিয় করা হয়, এবং গোটা ঘটনাই গোপন করে রাখা হয়।
এই ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ আছে ক্যাপ্টেন মোহন সিং কোহলির ২০০৩ সালের বই “Sherpas: The Himalayan Legends”-এ।
আপনার কী মনে হয়, দেশের রক্ষাই কী কাল হল পরিবেশের? নাকি অন্য কোনও কারণে ঘটছে উত্তরাখণ্ডের বিপত্তি? আর এই নিউক্লিয়ার ট্র্যাকিংয়ের মিশন সম্পর্কে আপনার কী মতামত? জানাবেন অবশ্যই।