এখনও সমাজের অন্ধকারে সিঙ্গুরের নার্স মৃত্যুর ঘটনা!

Singur Nurse Death Case
Singur Nurse Death Case

পশ্চিমবঙ্গের হুগলির সিঙ্গুর। একটি বেসরকারি নার্সিংহোমের চারতলার একটি ঘর থেকে হঠাৎ করেই উদ্ধার হল একজন নার্সের ঝুলন্ত দেহ (Singur Nurse Death Case)। আর তারপর থেকেই উত্তেজনা সেই হাসপাতালকে কেন্দ্র করে। বেড়েছে রাজনৈতিক উত্তেজনাও। রাজনীতির ছায়া ময়নাতদন্তেও।

কিন্তু, সাধারণ কোন আত্মহত্যা? নাকি খুন? নাকি কোন গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার রাজ্যের আরও এক তরুণী। আজ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ সমস্ত তথ্য এক এক করে আলোচনা করবো এই প্রতিবেদনে।

নাম দিপালী জানা। বাড়ি নন্দীগ্রামের রায়নগরে। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে, জীবনে বড় হওয়ার তাগিদে ব্যাঙ্গালোর থেকে নিজের নার্সিং পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। এরপর এক বান্ধবীর সূত্রে, আগস্ট মাসের দ্বিতিয় সপ্তাহে সিঙ্গুরের বোড়াই তেমাথা এলাকায় শিবম সেবাসদন নার্সিংহোমে চাকরি পান তিনি। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, তাল কাটে ২০২৫ সালের ১৩ আগস্ট।

১৩ আগস্টঃ

ওইদিন রাত ১১টায়, দিপালীর বাবা সুকুমার জানার কাছে একটি ফোন আসে নার্সিংহোম থেকে। মৃতার বাবা সুকুমার জানার কথায়, “আমাদের নার্সিংহোমে যেতে বলা হয়। আমরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানানো হয়, আমাদের মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। এরপর মাথায় এক রাশ প্রশ্ন নিয়ে ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছালে, আমাদের জানানো হয় যে পুলিশ এসে দীপালির দেহ নিয়ে গিয়েছে। কেন আমাদের না দেখিয়ে পুলিশ দেহ নিয়ে গেল?”

এরপর মৃতার বাবা ও পরিবারের তরফ থেকে অভিযোগ করে জানানো হয়, “আমাদের মেয়ে কোনও দিন আত্মহত্যা করতে পারে না। নার্সিংহোমের অনিয়মিত কার্যকলাপ প্রকাশ্যে আনার ফলে আমাদের মেয়ের ওপর যৌন নির্যাতন করে ওরা খুন করেছে। ওই নার্সিংহোমের মালিকের শাস্তি চাই।’’ অভিযোগের ভিত্তিতে থানায় খুন-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু হয়েছে।

হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছে, পরিবারের অভিযোগ ভিত্তিহীন, ওই নার্স আত্মহত্যা করেছেন।

১৪ আগস্টঃ

এরপর ১৪ আগস্ট, ময়নাতদন্তের জন্য মৃতার দেহ শ্রীরামপুর ওয়ালস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে হঠাৎ করেই জোড়ো হয় সিপিএম-বিজেপি কর্মীরা। ‘বিচার চাই’ স্লোগান দেখিয়ে দুই দলই বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। পরে পুলিশবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে হাসপাতালের সুপার দেহ সেখানে ময়নাতদন্ত না-করিয়ে তা রেফার করে দেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ মর্গে।

স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক এবং রাজ্যের মন্ত্রী বেচারাম মান্না জানান, “পুলিশের তদন্তে যদি ওই নার্সের মৃত্যুতে কোন অনিয়ম পাওয়া যায়, তবে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।“

১৫ আগস্টঃ

এরপর ১৫ আগস্ট, ওই নার্সের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় নাম উঠে আসে হাসপাতালের মালিক এবং দীপালি জানার প্রেমিকার। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাদেরকে।

তদন্তে জানা গিয়েছে, দীপালির প্রেমিক হিসাবে অভিযুক্ত ওই ব্যাক্তি রাধা গোবিন্দ ঘটক পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার বাসিন্দা এবং অন্য একটি নার্সিংহোমে কাজ করেন। কাজের সূত্রেই তাদের মধ্যে পরিচয় হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের ওই ব্যাক্তি জানিয়েছেন, সম্প্রতি দীপালি বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করছিল, কিন্তু রাধাগোবিন্দ নানা অছিলায় সেই প্রস্তাব এড়িয়ে যায়।ওই ব্যাক্তি আরও জানান যে, ১০ই আগস্ট তারা দুজনে একসাথে বেশ কিছু জায়গায় ঘোরাঘুরি করে ডানকুনির একটি হোটেলে থেকেছিলেন। শুধু তাই নয়, অতীতেও একাধিকবার তারা একসঙ্গে ঘুরতে গিয়েছে ও হোটেলে থেকেছে তারা।

পুলিশ প্রাথমিকভাবে অনুমান করেছে যে, হয়তো ওই ব্যাক্তির থেকে প্রেমে প্রত্যাখ্যান পাওয়ার পর দিপালী আত্মহত্যা করেছে।

এছাড়া তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, বুধবার রাতে বাড়ি যাওয়ার সময় দীপালির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন ওই নার্সিংহোমের মালিক, ফলে তাকেও আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তবে, পুলিশ এও জানিয়েছে, আমরা তদন্ত করছি, এবং কোন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ময়না তদন্তের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।

এরপর ওইদিনই কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে মৃতার দেহ ময়ানতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে সিপিএম এবং বিজেপির কর্মী সমর্থকদের মধ্যে। মূলত মৃতদেহের অধিকার কারা নেবে এই নিয়ে চলতে থাকে গণ্ডগোল। উভয় পক্ষই, উভয়ের বিরুদ্ধে তৃণমূলকে সাহায্য করার অভিযোগ তুলতে থাকে। এরপর মৃতার বাবা জানান, আমি চাই কেন্দ্রীয় কোন হাসপাতালে মেয়ের ময়নাতদন্ত হোক। পরিবারের অন্যান্য সদস্যও বলছেন, রাজ্য সরকারের উপর তাদের আস্থা নেই। তাই কেন্দ্রীয় হাসপাতালেই নার্সের দেহের ময়নাতদন্ত হোক। এরপর কল্যাণীর AIMS কিংবা কমান্ড হাসপাতালে ময়নাতদন্ত চেয়ে পুলিশকে চিঠি দেয় পরিবার।

তবে, মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এমস হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করাতে হলে আদালত থেকে সম্মতি নিয়ে আসতে হবে। কলকাতা মেডিক্যালের কর্তৃপক্ষ এমস হাসপাতালে রেফার করতে পারবেন না।

১৬ই আগস্টঃ

তবে, ১৬ই আগস্ট জানা যায় কল্যাণীর এমস হাসপাতালে হাসপাতালেই ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে, ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ময়নাতদন্ত চলছে। এবং স্বচ্ছতার স্বার্থে গোটা প্রক্রিয়াটির ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়। এরপর টানা ৩ ঘণ্টা ময়না তদন্ত শেষে তরুণীর দেহ মা-বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয়, এবং ওই দিনই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।

ময়নাতদন্তের রিপোর্টঃ

এরপর ১৯শে আগস্ট ময়না তদন্তের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে জানা গিয়েছে, শরীরে আঘাতের কোনও চিহ্ন নেই। গলায় ফাঁস লাগিয়ে মৃত্যু হয়েছে দীপালি জানার। পরিবারের তরফ থেকে সিবিআই তদন্তের অনুরোধ করা হয়েছে।

যে প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরাঃ

প্রথমত, মৃতার বান্ধবী মল্লিকা বাউরি, যিনি পেশায় একজন নার্স, তিনি প্রথম দিপালীর ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করেন। তিনি জানিয়েছেন, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে মল্লিকা দীপালিকে দেখতে পায়। তবে, মল্লিকা ছাড়া এই দৃশ্য আর কে কে দেখেছে, কিংবা মল্লিকার দেহ কারা বের করলো, এবং কখন মৃতার পরিবারকে জানানো হল সেই নিয়ে কোন পরিষ্কার উত্তর পাওয়া যায়নি।

দ্বিতীয়ত, সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে কি তথ্য পাওয়া গেল, কিংবা প্রেমিক ও অন্যান্য কর্মীদের সাথে মৃতার কল লিস্ট সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত কোন তথ্য সামনে আসেনি।

Leave a Comment