দিনটা ২০২১ সালের মার্চ। ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে ঘোষণা করা হয় গ্রেট নিকোবর প্রকল্পের (Great Nicobar Project)। আর ওই বছরের নভেম্বর মাসে এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা। প্রধানত সমুদ্র বাণিজ্যে চিনকে টক্কর দেওয়া, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তার করা এবং বিপুল কর্মসংস্থান এই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্দেশ্য। পাশাপাশি এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের শিপমেন্ট খাতে অনেক খরচ যেমন বাঁচবে, তেমনই প্রতিবছর এই প্রকল্প থেকে আয় হবে অনেক বেশি পরিমাণ টাকা। কিন্তু এই প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যেই উঠেছে তীব্র আপত্তি, মামলা গড়িয়েছে হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টেও। আদতে ২০২৪ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, আইনি ও পরিবেশগত বিতর্কের কারণে কার্যত পিছিয়ে গিয়েছে এই কাজ। কিন্তু, যে প্রকল্পের ফলে দেশে বাড়বে কর্মসংস্থান, ব্যয়ের পরিবর্তে দেশে বাড়বে আয়, সেই প্রকল্প নিয়ে কেন উঠছে এত প্রশ্ন? কী বলছেন পরিবেশবিদ থেকে বিশেষজ্ঞরা? চলুন জেনে নেওয়া যাক এক এক করে।
গ্রেট নিকোবর প্রকল্প কী? | What Is Great Nicobar Project?
সবার প্রথমেই আমরা জেনে নেবো কী এই গ্রেট নিকোবর প্রকল্প। ভারতের পূর্ব উপকূলের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। প্রায় ৮৩৬টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই অঞ্চল, যার মধ্যে ৩৮টি দ্বীপে বর্তমানে জনবসতি রয়েছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রায় ১৫০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত রয়েছে নিকোবর। নিকোবরের আকার প্রাত ৯১০ বর্গ কিলোমিটার।
আর এই নিকোবরের প্রায় ১৬৬ বর্গ কিমি জুড়ে একটি ট্রান্সশিপমেন্ট হাব, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিমানবন্দর এবং টাউনশিপ তৈরি করার লক্ষ্য নিয়েছে ভারত সরকার। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৩০ বছর, এবং বিনিয়োগ করা হবে প্রায় ৭২,০০০ কোটি টাকা থেকে ৮১,০০০ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পে মোট চারটি প্রধান উপাদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে, গ্যালাথিয়া উপসাগরে একটি আন্তর্জাতিক ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর নির্মাণ, যা দেশের ১৩তম বন্দর হিসাবে গড়ে উঠবে। এই বন্দর বার্ষিক ১৪.৫ মিলিয়ন টিইইউ অর্থাৎ ২০-ফুট সমতুল্য ইউনিট পর্যন্ত পরিচালনা করার জন্য প্রস্তাবিত হয়েছে।
দ্বিতীয় উপাদান হিসাবে, এই প্রকল্পের অধীনে গড়ে তোলা হবে ৩,৩০০ মিটার রানওয়ে সহ একটি গ্রিনফিল্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যা যাত্রীবাহী বিমান পরিচালনা করতে সক্ষম।
এই প্রকল্পের তৃতীয় উপাদান হিসাবে গড়ে তোলা হবে একটি ৪৫০ মেগাওয়াট গ্যাস-ভিত্তিক এবং সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এই প্রকল্পের চতুর্থ এবং শেষ উপাদান হিসাবে গড়ে তোলা হবে একটি টাউনশিপ। যার আয়তন হবে প্রায় ১৬,৫৬৯ হেক্টর। এখানে শ্রমিক এবং অভিবাসী সহ প্রায় ৬৫,০০০ জন বাসিন্দা বসবাস করতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতেঃ কী কী লাভ হতে পারেঃ
সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রেট নিকোবর প্রকল্পের অন্তর্গত আন্তর্জাতিক ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর নির্মাণ হলে দেশের অর্থনৈতিক সাশ্রয় বাড়বে। কারণ বর্তমানে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশই পরিচালিত হয় বিদেশি বন্দর থেকে। কিন্তু, গ্যালাথিয়া উপসাগরীয় বন্দর তৈরি হলে শুধু নয়াদিল্লির ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ বাঁচবে প্রায় ২০ থেকে ২২ কোটি টাকা। পাশাপাশি এই বন্দর তৈরি হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে প্রায় ৫০,০০০ জনের।
এছাড়াও, এই বন্দরের ফলে চীন-প্রভাবিত মালাক্কা প্রণালীর কাছে সিঙ্গাপুরের ট্রান্সশিপমেন্টের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে ভারত, যা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের প্রায় ২৫% বহন করে। এই বন্দরের ফলে, ভারত মালাক্কা প্রণালী থেকে আঞ্চলিক পণ্য পরিবহনের ২০-৩০% দখল করে বিদেশী কেন্দ্রগুলির উপর নির্ভরতা কমাতে পারবে। পাশাপাশি গ্রেট নিকোবর প্রকল্পটি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি পূর্ব ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সম্ভাব্য সামুদ্রিক হুমকির বিরুদ্ধে ভারতের সামনের সারির ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতকে ঘিরে ফেলতে চীনের ‘মুক্তার মালা’ (স্ট্রিং অব পার্লস) কৌশলের পাল্টা হিসেবে এটি ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হতে পারে। কারণ গ্রেট নিকোবর থেকে ভারতীয় নৌবাহিনী সহজেই দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যপথে নজরদারি চালাতে পারবে।
বিশেষজ্ঞদের মতেঃ কী কী ক্ষতি হতে পারেঃ
এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আওয়াজ তুলেছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। কারণ এই জায়গাটি অত্যন্ত জীববৈচিত্র্যপূর্ণ একটি অঞ্চল, পাশাপাশি এই জায়গা ৩০০ সদস্যের একটি বিলুপ্তপ্রায় উপজাতি জারোয়া, নর্থ সেন্টিনেলিজ, গ্রেট আন্দামানিজ, ওঙ্গে ও শোম্পেনদের বাসস্থান। এই নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ৮০ শতাংশ রেনফরেস্ট বনাঞ্চল দ্বারা আচ্ছাদিত। এটি ১৮০০-র বেশি প্রাণী এবং ৮০০-র বেশি প্রজাতির উদ্ভিদের আবাসস্থল। সরকার জানিয়েছে এই মেগা প্রকল্পের জন্য দ্বীপের মাত্র ১৩০ বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ ১৪ শতাংশ জমি পরিষ্কার করা হবে। কিন্তু সেই বন পরিস্কারের সাথে প্রায় ৯ লক্ষ ৬৪ হাজার গাছের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। সোশ্যাল ইকোলজিস্ট ড. মনীশ চণ্ডী এই বিষয়ে বলেছেন, মেগা প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত এলাকায় লবণাক্ত জলের কুমির, ওয়াটার মনিটর, মাছ, লেদারব্যাক সামুদ্রিক কচ্ছপ, প্রবাল ও জায়ান্ট রবার ক্র্যাব সহ বিশেষ প্রজাতির পাখি রয়েছে, যারা ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ওই প্রকল্পের ফলে এসব প্রজাতির বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্রের কোনও পরিবর্তন করা হবে না।
তবে, সরকার যাই বলুক, এই নিয়ে তর্ক কিন্তু থামছে না এখনই। কারোর দাবি পরিবেশ সুরক্ষা, কারোর দাবি দেশের উন্নতি! কিন্তু, আদতে কী হবে, তার উত্তর দেবে সময়।