সহেলি মিত্র, কলকাতা: দুঃখু মাঝি… পরিবেশ নিয়ে যারা একটু জ্ঞান রাখেন তাঁরা এই মানুষটিকে চিনবেন নিশ্চয়ই। পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডির দুর্গম ভূখণ্ডের কেন্দ্রস্থলে, সিন্দ্রি গ্রামের ঘন সবুজে ঘেরা জায়গায় এমন একজন মানুষ বাস করেন যার বনায়নের প্রতি অটল নিষ্ঠা তাকে দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান এনে দিয়েছে। তবুও আজ, পদ্মশ্রী প্রাপক দুঃখু মাঝি একটি ভেঙে পড়া টিনের ছাদের নীচে বেঁচে আছেন। তার গৌরবের কৃতিত্ব যখন এখনো অবধি মানুষের ঠোঁটস্ত, সেখানে মানুষটি কীভাবে এখন বসবাস করছেন সে সম্পর্কে জানলে আপনিও চমকে উঠবেন।
কেমন আছেন দুঃখু মাঝি?
ছোটবেলা থেকেই দুঃখু গাছ লাগানোর প্রতি গভীর ভালোবাসা পোষণ করতেন। স্কুল ছাড়ার পরও, সেই সবুজ আবেগ তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল – তার জীবন মাটি, শিকড় এবং চারাগাছের সাথে মিশে গিয়েছিল যা তিনি এত ভালোবাসার সাথে যত্ন করেছিলেন। সেই আবেগই অবশেষে তাকে চড়িদা-বীরগ্রামের ধুলোময় গলি থেকে রাইসিনা হিলসের পালিশ করা মেঝেতে নিয়ে যায়। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু দুঃখুবাবুকে পদ্মশ্রী (Padma Shri Dukhu Majhi) প্রদান করেন, যা কেবল সিন্দ্রি নয়, সমগ্র পুরুলিয়া বনাঞ্চলে গর্বের সাথে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।
কিন্তু ক্যামেরার ঝলকানি এবং জাতির করতালির বাইরেও বাস্তবতা এক ভয়াবহ চিত্র সামনে উঠে এসেছে। আজ দুঃখু মাঝি চরম দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করছেন। তার শরীর যেমন বয়সের ভারে ভাঙছে, ঠিক তেমনই তিনি থাকছেনও এক জীর্ণ মাটির ঘরে। তিরপল দিয়ে বাঁধানো এবং বাঁশের খুঁটি দিয়ে শক্ত করা এক ঘরে থাকছেন তিনি। প্রতিটি বৃষ্টির সাথে সাথে, কাঠামোটি আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, কারণ ফাটলযুক্ত মাটির দেয়াল এবং ক্ষতিগ্রস্ত ছাদের মধ্য দিয়ে বৃষ্টির জল চুইয়ে পড়ে। জল আটকাতে পেতে রাখা হয়েছে খড়।
একি করুণ দশা রাষ্ট্রপতি দ্বারা পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপকের!
সম্প্রতি এক ইউটিউবার পদ্মশ্রী দুঃখু মাঝির বাড়ি গিয়েছিলেন। আর সেখান থেকেই তিনি তাঁর দুর্দশার কাহিনী তুলে ধরেন। দুঃখু মাঝির স্ত্রী, ফুঙ্গি, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন অত্যন্ত উদ্বিগ্নতা নিয়ে। মাথার ওপর সামান্য যে আশ্রয় আছে সেটাও যে আর বেশিদিন থাকবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তিনি জানান, ‘কয়েকদিন আগেও সারা রাত বৃষ্টি থামেনি। আমি ঘুমাতে পারিনি। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে বাড়িটি আমাদের উপর ভেঙে পড়বে।’ ভঙ্গুর এই বাসস্থানের ভেতরে তিনি তার প্রতিবন্ধী ছোট ছেলে শম্ভুর সাথে থাকেন। তার বড় ছেলে নির্মল অন্যত্র সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত একটি বাড়িতে থাকেন – বিদ্রূপাত্মকভাবে, পদ্মপুরষ্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়ার কথা ছিল এমন একটি বাড়িতে।
আরও পড়ুনঃ “লক্ষ্মীর ভান্ডার বন্ধ হলেই রাস্তা হবে!” রাজগঞ্জের BDO প্রশান্ত বর্মনের মন্তব্যে তোলপাড়
দুঃখু মাঝির অভিযোগ, “আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আবাসন প্রকল্পের আওতায় কেবল একটি পরিবারকে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই, আমার ছেলে সেখানে থাকে।”
কেন পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার?
পুরুলিয়া তথা সমগ্র বাংলার গর্ব দুঃখু মাঝি জানান, ‘আমি গাছ লাগাই। পরিবেশ ভালোবাসি। মোরা কাঠের জিনিসপত্র তৈরী করি।’ জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ৫,০০০ টিরও বেশি গাছ লাগিয়েছেন। জানলে অবাক হবেন, এই বৃদ্ধ বন বিভাগের অফিস থেকে চারা সংগ্রহ করেন এবং সাইকেলে ভ্রমণের সময় মাঠে, নদীর ধারে এমনকি শ্মশানেও রোপণ করেন। দুঃখু মাঝি বলেন যে তার জীবনের উদ্দেশ্য প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করা এবং একটি সবুজ পরিবেশ গড়ে তোলা, যা তাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন একটা মানুষের দিন এভাবে চরম দারিদ্রতার সঙ্গে কাটছে তা সত্যিই দেখা যায় না।