প্রীতি পোদ্দার, কলকাতা: বছর ঘুরলেই বিধানসভা নির্বাচন। মুখ্যমন্ত্রীর সিংহাসনে কে বসতে চলেছে তা নিয়ে ঘোর জল্পনা শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায় সমস্ত রাজনৈতিক দল যেখানে নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত, সেই সময় প্রকাশ্যে এল মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে বিজেপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ। অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর সরাসরি আক্রমণ শানালেন ছোট ভাই, বনগাঁর সাংসদ ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে। তবে এই দ্বন্দ্ব দুই ভাইয়ের মধ্যেই শুধু রইল না, পরিবারের মধ্যেও ব্যাপক বিভাজন স্পষ্ট করল।
ঘটনাটি কী?
রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে CAA কার্যকর হওয়ার পর থেকেই প্রথম ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়িতে মতুয়া সমাজের জন্য সহযোগিতা শিবির চালু করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর রাজ্যের ভোটার তালিকায় SIR এর তোড়জোড় শুরু হতেই রাজ্যের নানা প্রান্তে বিজেপি ‘CAA সহযোগিতা শিবির’ খোলা শুরু করেছে। যার দরুন ঠাকুরবাড়ির সহযোগিতা শিবিরেও তৎপরতা বেড়েছে। এই মুহূর্তে ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দিরে শিবিরটি চালু করা হয় এলাকার সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের উদ্যোগে। সেখানে মতুয়া সমাজের যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের CAA আবেদন জমা দিতে সহায়তা করা হচ্ছে। এমনকি ধর্মীয় পরিচিতি সংক্রান্ত শংসাপত্র এই নাটমন্দির থেকে দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু গতকাল সেই শিবিরকে কেন্দ্র করে দুই ভাই সুব্রত এবং শান্তনুর মধ্যে বিবাদ প্রকাশ্যে এল।
শান্তনুর কর্মকাণ্ডে নারাজ সুব্রত
সুব্রত ঠাকুর নাটমন্দিরে CAA সহযোগিতা শিবির গড়ে তোলা নিয়ে অভিযোগ জানায়। তিনি বলেন যে, ভক্তদের পূজা-অর্চনার জায়গা নাটমন্দিরকে কেন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন শান্তনু? এমনকি নাটমন্দিরের নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করার অভিযোগও তুলেছেন সুব্রত। আর এই প্রশ্ন উঠতেই পাল্টা জবাব ধেয়ে আসে শান্তনু ঠাকুরের। তাঁর দাবি, “নাটমন্দিরে তো ভক্তদের জন্যই কাজ চলছে। সেখানে তো কোনও রাজনৈতিক কাজ তো চলছে না। সরকারের কাছে আবেদন জমা দিতে মতুয়া ভক্তদের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তার জন্যই তো শিবির খোলা হয়েছে।’’ এমতাবস্থায় ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও পরিবারের দুই ছেলের পক্ষে আলাদা অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
পরিবারে স্পষ্ট বিভাজন
রবিবার ঠাকুরনগরের নাটমন্দিরে CAA সহযোগিতা শিবির নিয়ে শান্তনু এবং সুব্রত ঠাকুরের এই দ্বন্দ্বে পরিবারে বড় ভাঙন দেখা গিয়েছিল। বড় ছেলে সুব্রত ঠাকুরের পাশে দাঁড়ালেন মা ছবিরানি ঠাকুর এবং জেঠিমা তথা তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর। আবার ছোটছেলে শান্তনু ঠাকুরকে এ বিষয়ে সমর্থন করলেন তৃণমূল সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান সেবায়েত মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। এদিকে শান্তনু, সুব্রতর বিরুদ্ধে ‘তৃণমূলে যাওয়ার চেষ্টা’ করারই অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সুব্রত ঠাকুর তৃণমূলে যেতে চাইছেন। মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়ার এই অজুহাত নিয়ে অকারণে একটা অশান্তি তৈরি করছেন।’’
কী বলছেন সুব্রত ঠাকুর?
শান্তনু ঠাকুরের একের পর এক অভিযোগে চুপ করে থাকেনি দাদা সুব্রত ঠাকুর। তিনি বলেন, ‘‘পরিবার আমার কাছে আগে। পরে রাজনীতি। মাকে নিয়ে আমি জেঠিমা আর বোনের সঙ্গে বৈঠক করেছি।’’ জেঠিমা মমতাবালা ঠাকুরও সুব্রতের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, নাটমন্দিরে কেন সহযোগিতা শিবির চলবে? এমনকি সুব্রতের মা ছবিরানিও অভিযোগ তোলেন যে, ‘‘শান্তনুর নেতৃত্বে ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। মহাসঙ্ঘাধিপতি হিসেবে সুব্রত যা করেছেন, তা ন্যায্য অধিকার।’’
আরও পড়ুন: উৎপাদন হবে দ্বিগুণ, দুধের জোগান বাড়াতে হরিণঘাটায় নয়া কারখানা খুলছে ‘বাংলার ডেয়ারি’
ওদিকে ঠাকুরনগরের নাটমন্দিরে CAA সহযোগিতা শিবির নিয়ে বাবা মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর ছোট ছেলে শান্তনু ঠাকুরের পক্ষ নিলেন। তাঁর স্পষ্ট দাবি, “পারিবারিক মতপার্থক্য থাকলে ভিতরে আলোচনা করা যেত। বাইরের শক্তিকে এনে ঝামেলা বাড়ানো হচ্ছে কেন? এখানে তৃণমূলকেই বা ঢোকানো হচ্ছে কেন? সুব্রত এবং ছবিরানির এই আচরণকে আমি সমর্থন করছি না’’ ফলে মতুয়া রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঠাকুরবাড়িতেই এখন চলছে কার্যত দ্বিমুখী লড়াই। সেক্ষেত্রে ওয়াকিবহাল মহল-এর তরফে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে নির্বাচনের আগে বিজেপির এই দ্বন্দ্ব দলের ওপর বড় প্রভাব পড়বে।
এদিকে ঠাকুরনগরের মুষলপর্বে ঢুকতে চাইছে না বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির একটি সূত্র জানাচ্ছে, এ বিষয়ে দলের নয়া রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মৌন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কেউই প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাইছেন না। তাঁদের মতে দুই ভাইয়ের মধ্যে যা সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা খুব শীঘ্রই মিটে যাবে।