বিক্রম ব্যানার্জী, কলকাতা: “পরিশ্রমই সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি” হিরো থেকে জিরো হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের পেছনে বোধহয় এই বাংলা প্রবাদ বাক্যই একেবারে মন্ত্রের মতো কাজ করেছে। সে ধীরুভাই আম্বানি হোক কিংবা বালাজি ওয়েফারসের (Balaji Wafers) প্রতিষ্ঠাতা চান্দুভাই বিরানি (Chandubhai Virani)। হ্যাঁ, শূন্য থেকে শুরু করে আজ বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক শিল্পপতিদের তালিকায় একেবারে শীর্ষে না হলেও প্রথম সারির কোনও না কোনও জায়গায় নাম রয়েছে গুজরাতের ঘরের ছেলের (Success Story)।
মাত্র 15 বছর বয়সে নিজেদের শেষ সম্বল জমিটুকুও বিক্রি করে দিয়েছিলেন বাবা। তা থেকে যা পাওয়া গিয়েছিল সেই অর্থের কিছু অংশ ভাগের ভাগ হিসেবে পেয়েছিলেন চান্দুভাই। সেই মূলধন এবং নিজের একাগ্রতাকে সঙ্গী করেই আজ তাঁর সংস্থার বাজার মূল্য 33,000 কোটিরও বেশি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়, বালাজি ওয়েফারসের একটি অংশে 282 মিলিয়ন অর্থাৎ 2,500 কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চলেছে আমেরিকার বেসরকারি ইকুইটি ফার্ম জেনারেল আটলান্টিক। আর সেটা হলে, গুজরাতের শিল্পপতির সংস্থার বাজার মূল্য 4 বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় 35,000 কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
90 টাকা মাইনের চাকরি থেকে আজ প্রায় 35,000 কোটির মালিক চান্দুভাই
বয়সটা তখন মাত্র 15। সংসার চালাতে শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে হয়েছিল চান্দুভাইয়ের বাবাকে। যার বিনিময় সেই সময় পেয়েছিলেন মাত্র 20,000 টাকা। সেটাই ভাগ করে দিয়েছিলেন তিন ছেলের মধ্যে। বলেছিলেন, “এই টাকা দিয়েই একটা ব্যবসা শুরু কর।” তবে সংসারের হাল দেখে সেই সময় প্রথমেই ব্যবসা শুরুর কথা মাথায় আসেনি চান্দুভাইয়ের। উইকিপিডিয়া ঘেঁটে জানা গেল, প্রথমদিকে বাবার পরামর্শে ভাইদের সাথে একটি ছোট্ট খামারের ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। তবে ব্যবসা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান না থাকার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছিল প্রথম স্টার্ট আপ। তবে হার মানেনি চান্দু।
1946 সালে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পর কাজের সন্ধানে গুজরাতের অস্ট্রোন সিনেমা হলের বাইরে ঘোরাঘুরি করতেন চান্দুভাই। এভাবেই একদিন এক থিয়েটার কর্মীর চোখে পড়ে যান তিনি। সেখান থেকেই ওই সিনেমা হলের একটি ক্যান্টিনে কাজের সুযোগ হয় তাঁর। সেই সময় ক্যান্টিনের কর্মচারী হিসেবে চান্দুভাই বেতন পেতেন মাসিক 90 টাকা। যা দিয়ে আজকের দিনে এক প্যাকেট বিরিয়ানিও হয় না। সেই সময়, ওই 90 টাকা মাইনেতেই ক্যান্টিনের যাবতীয় বাসনপত্র ধোঁয়া থেকে শুরু করে কাস্টমারদের আসন পরিষ্কার করা সহ এলাকার চারপাশে ক্যান্টিনের বিভিন্ন পোস্টার সাঁটানোর কাজও করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ভাগ্যের ফের সিনেমা হলের ম্যানেজারের চোখে পড়ে যান চান্দুভাই। সেখান থেকেই শুরু হয় মাসিক 1,000 টাকা বেতনের কাজ।
একাধিক মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, সিনেমা হলে কাজ করাকালীন কীভাবে নিজের একটা ব্যবসা গড়বেন সে কথাই ভাবতেন চান্দু। একটা সময় আসে, গুজরাতের ব্যবসা পাগল ছেলে ঠিক করে নেয় নিজের বেতন থেকে কিছু কিছু করে বাঁচিয়ে 10,000 টাকা জমাবেন। সেটাই হবে তাঁর ব্যবসার মূলধন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরবর্তীতে ওই টাকা দিয়েই একটি ছোট্ট দোকান ভাড়া নেন চান্দু। সেই সাথে বেঁচে থাকা অর্থ দিয়ে কিছু কাঁচামাল কিনে শুরু করে দেন ওয়েফারের ব্যবসা। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, এই সময় মাত্র 10,000 হাজার টাকা পকেটে নিয়ে প্যাকেটজাত চিপস তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। নিজের নতুন ব্যবসার পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছিলেন সিনেমা হলের কাজও।
নতুন ব্যবসা শুরু হলেই যে ক্রেতাদের ভিড় উপচে পড়বে না, সেটা বুঝেছিলেন চান্দুভাই। তাই দাঁতে দাঁত চেপে ব্যর্থতা নিয়েই এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত, দেখা মিলল জীবনের সেই মোড়ের যেখান থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি চান্দুকে। চিপসের ব্যবসায় লক্ষ্মীলাভ হতেই 1989 সালে বালাজি পটেটো ওয়েফার নামক একটি সংস্থা খুলে ফেলেন তিনি। যদিও সে বছর নতুন কোম্পানির জন্য ব্যাঙ্ক সহ অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে সর্বসাকুল্যে মোট 50 লক্ষ টাকা লোন নিতে হয়েছিল চান্দুকে। জানা যায়, প্রথম দিকে নিজেই প্যাকেটজাত চিপস বানিয়ে সাইকেলে করে দোকানে দোকানে দিয়ে আসতেন তিনি। পরে ব্যবসা কিছুটা আশার আলো দেখালে কর্মী নিয়োগ করতে শুরু করেন চান্দুভাই। মাত্র দু বছরের মধ্যেই ফুলেফেঁপে ওঠে ব্যবসা। চান্দুভাই বুঝতে পারেন এবার হয়তো ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছেন। সেখান থেকেই পথ চলা শুরু বালাজি ওয়েফারস প্রাইভেট লিমিটেডের। আজ গুজরাতের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে চান্দুভাইয়ের পটেটো চিপ সহ অন্যান্য স্ন্যাকসের ব্যবসা।
একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা দাঁড় করিয়ে গুজরাতের শিল্পপতি প্রমাণ করেছেন শুধুমাত্র ইচ্ছা শক্তি আর চেষ্টা থাকলেই সবাই সব কিছু করতে পারে। আসলে চান্দুভাই বিশ্বাস করেন, দীর্ঘ অধ্যবসায়, ব্যবসা করার জেদ এবং প্রবল ইচ্ছা শক্তিই তাঁকে আজ একজন সফল ব্যক্তিদের রূপান্তরিত করছে। না বললেই নয়, 2024 সালে চান্দুভাইয়ের কোম্পানি বালাজি ওয়েফার্স প্রাইভেট লিমিটেডের বার্ষিক টার্নওভার ছিল 5,454 কোটি টাকা। যা গত 2023 সালের তুলনায় অনন্ত 10 শতাংশ বেশি।
অবশ্যই পড়ুন: বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ফেসবুকের লাইক বাটন! কবে থেকে? তারিখ ঘোষণা করল Meta
প্রসঙ্গত, একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের অন্যান্য সংস্থার মতো বিজ্ঞাপনের পেছনে না ছুটে গ্রাহকদের স্বার্থে খাবারের গুণমানের উপর প্রথম থেকেই জোর দিয়েছিল চান্দুভাই বিরানির সংস্থাটি। অন্যান্য ব্র্যান্ডগুলি যেখানে নিজেদের বিজ্ঞাপনের জন্য 20 থেকে 30 শতাংশ বা তারও বেশি অর্থ ব্যয় করে, সেই পর্বে দাঁড়িয়ে বালাজি মাত্র 4 শতাংশ অর্থ সংস্থার বিভিন্ন প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনের জন্য খরচ করে থাকে। সংস্থাটির দাবি, প্রোডাক্টের গুণমানই সাফল্যের একমাত্র সূত্র। যেই ধারাবাহিকতা আজও স্বগর্বে ধরে রেখেছে গুজরাতের শিল্পপতি চান্দুভাইয়ের সংস্থা।