India Hood Decode: বালি মাফিয়ার আসল মাস্টারমাইন্ড! কে এই অরুণ শরাফ

Who Is Arun Saraf
Who Is Arun Saraf

কয়লা পাচার, গরু পাচারের পর এবার সারা রাজ্যজুড়ে তোলপাড় বালি পাচার কাণ্ড! বালি পাচার মামলায় অরুণ শরাফকে (Arun Saraf) প্রথম গ্রেফতার করল ED। যার নামে রয়েছে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা কারচুপির অভিযোগ! বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নগদ ২৯ লক্ষ টাকা। ইনি এমন এক ব্যাক্তি, যার নামে ভুয়ো চালান থেকে শুরু করে টাকা আত্মসাৎ, বালি পাচারের টাকা গায়েব – রয়েছে প্রায় সব ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ। এমনকি তার নাম উঠে এসেছে বিখ্যাত দেওচা পাচামি প্রকল্পেও।

এই খবরটা এখনও পর্যন্ত খুবই সাধারণ মনে হলেও, ব্যপারটা কিন্তু একদমই সাধারণ নয়। কারণ এই গ্রেফতারির পরে উঠে এসেছে এমন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য, ঠিক যেন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে।

কিন্তু কে এই অরুণ শরাফ? কেন তাকে গ্রেফতার করল ED? কবে থেকেই বা তার এই উত্থান? তার এই উত্থানের পিছনে কি হাত আছে তৃণমূলের? দেওচা পাচামি কাণ্ডে কীভাবে যুক্ত তিনি? আজ এক এক করে সমস্ত তথ্য ডিকোড করবে India Hood।

কে এই অরুণ শরাফ? | Who Is Arun Saraf?

অরুণ শরাফ – একজন ব্যবসায়ী, যার নামে রয়েছে একগুচ্ছ কোম্পানি। MCA-র অফিসিয়াল তথ্য অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত তার নামে রেজিস্টার্ড হয়েছে ২০টির বেশি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। যে কোম্পানিগুলিতে তিনি ডিরেক্টর, অংশীদার, প্রমোটার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর DIN নম্বর 05113697।

তার নামে যে সমস্ত কোম্পানিগুলি রয়েছে, সেগুলি মূলত মাইনিং অর্থাৎ খনির কাজের সাথে যুক্ত। এছাড়া কিছু কোম্পানি রয়েছে পরিবহন, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম উৎপাদন, ব্যবসায়িক পরিষেবা, ভ্রমণ, নির্মাণ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত।

তিনি ২০১১ সালের ২২শে ডিসেম্বর, প্লাসম্যাট বায়োটেক প্রাইভেট লিমিটেডের ডিরেক্টর পদে বসেন। আর সেই থেকেই শুরু। সেই থেকে তিনি এখনও পর্যন্ত জি ডি উদ্যোগ (GEE DEE UDYOG), অভিন্ন (ABHINNA) এবং মেটিসের (METIS) মতো একাধিক কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন সময়ে অধিষ্ঠিত থেকেছেন এবং আছেন। অভিন্ন সংস্থার নামটি কিন্তু একটু মনে রাখবেন। কারণ এই অভিন্নকে ঘিরেই রয়েছে একটি বিরাট খেলা।

কেন তাকে গ্রেফতার করল ED?

২০২৫ সালের ৬ই নভেম্বর। বালি পাচার কাণ্ডে রাজ্যে প্রথমবার কোনও ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ইডি। ভুয়ো ই-চালান তৈরি করে বালি পাচার, রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার কারবার চালানোর অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। অরুণের বিরুদ্ধে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা কারচুপি করার অভিযোগও উঠেছে। যার মধ্যে নগদ ২৯ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে তার বাড়ি থেকে। তদন্তে ইডি জানতে পেরেছে, ১০৩ কোটি টাকার বালি বিক্রির কথা বললেও তাঁর অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে ১৩০ কোটি টাকা!

যদিও এর অনেক আগেই অরুণের ওপর নজর পড়ে ইডি-র। ইডি তদন্ত করে দেখে – নিজের নামে সঠিকভাবে বালি খাদান লিজ নিত অরুণ। কিন্তু, বালি তোলার সময় নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত বালি তুলত অরুণের সংস্থা। টাকা ঢুকত অরুণের একাধিক অ্যাকাউন্টে। আর সেই টাকা হাওয়ালার মাধ্যমে পাচার হত বিদেশেও। এমনকি ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কোনও হিসাব অরুণের সংস্থা দিতে পারেনি।

কিন্তু, এখনও অবধি আপনার মনে হতেই পারে এটি একটি সাধারণ ব্যাক্তির স্ক্যাম। তবে, ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন অন্য কিছু। অরুণ শরাফ যে সমস্ত সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন, কিংবা যে সমস্ত সংস্থার কর্ণধার থেকেছেন এবং আছেন, সেই সব সংস্থাই তৈরি কিংবা সক্রিয় হয়েছে ২০১১ সালের পর থেকে। একরকমভাবে এটা বললে ভুল হয় না, রাজ্যে যবে থেকে উত্থান হয়েছে তৃণমূলের, তবে থেকেই উত্থান হয়েছে অরুণ শরাফের। তাই রাজ্যের বিরোধী দল এই পাচার কাণ্ডের সাথে সরাসরি তৃণমূল যোগের অভিযোগ করেছে।

তবে, খেলা কিন্তু এখানেই শেষ নয়!

এবার আমরা এই অরুণ শরাফের আরও একটি কর্মকাণ্ডের কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো, যা এতদিন লুকিয়ে রেখেছে বাংলার সমস্ত মেনস্ট্রিম মিডিয়া। চলতি বছরেই, আমাদের রাজ্যের এক জেলার এক গ্রামে চলছে কয়লা, পাথর নিয়ে সরকার আর সাধারণ মানুষের লড়াই। আর সেই লড়াই হচ্ছে দেওচা-পাচামি-তে।

দেওচা-পাচামি – বহু বছর ধরেই পাহাড়, বনভূমি দিয়ে ঘেরা আদিবাসীদের একটি গ্রাম। যেখানে হঠাৎ করেই কয়েক বছর আগে ভারতের সবচেয়ে বড় কয়লা খনি প্রকল্প তৈরির কথা জানা যায়। এই খনির দায়িত্ব দেওয়া হয় WBPDCL (West Bengal Power Development Corporation Limited)-কে। কিন্তু খনি থেকে কয়লা পেতে হলে আগে সরাতে হবে পাথরের এক বিশাল স্তর — যাকে বলে বেসাল্ট
তাই শুরু হয় “বেসাল্ট মাইনিং প্রজেক্ট” নামে আলাদা এক উদ্যোগ। আর এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় এক একাধিক কোম্পানিকে অর্থাৎ একটি কনসোর্টিয়ামকে

আর এই কারণে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ঘোষণা করা হয় একটি টেন্ডার। আর সেখানে যারা জেতে, তাদের মধ্যে ছিল Abhinna Mining Private Limited নামের কোম্পানি। অর্থাৎ, কী খেলা সেটা বুঝলেন তো। আর টেন্ডার জেতার পরেই, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে, অভিন্ন মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেডের ডিরেক্টর পদ থেকে সরে যান অরুণ শরাফ। অর্থাৎ, এমনটা মনে করা হচ্ছে কাজ হাসিল হতেই সরে যান তিনি।

না না খেলা এখানেই শেষ নয়। এবার, এই কনসোর্টিয়াম গঠনের সময় সরকার নিজেদের টেন্ডারে বলেছিল যে “কোনও কোম্পানি টেন্ডার জেতার পর তার দলবদল করতে পারবে না”। কিন্তু দেখা গেল, জেতার পরে পরেই কোম্পানি নিজেদের দল পরিবর্তন করে ফেলেছে। অর্থাৎ শুরুতেই খেলাপি।

যার ফলে, গ্রামের মানুষ ভয় পেতে শুরু করে। তাদের অভিযোগ – যেখানে আগে চাষ হত, গবাদি পশু চরত, সেখানে এখন পাথর খনন হবে। জমি চলে গেলে তারা যাবে কোথায়?

সরকার বলছে — “সব কিছু নিয়ম মেনে হয়েছে। এখন শুধু কয়লা নয়, আগে পাথর (বেসাল্ট) সরানোর কাজ চলছে। এতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”

কিন্তু, প্রতিবাদ এতই জোরালো আকার ধারণ করেছে, পরিস্থিতি এতই জটিল হয়েছে যে পুলিশ-প্রশাসন সম্পূর্ণ জায়গাটিকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে, সাংবাদিকদেরও এলাকায় ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না।

তবে কি বালির পাশাপাশি চলছিল পাথর পাচারেরও চক্র?

এবার আপনার মনে হতেই পারে, এসব তো তাহলে সরকারের গাফিলতি! কিন্তু, এই ঘটনার সাথে তৃণমূলের যোগ পাওয়া যায় যখন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারি অভিযোগ করেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারা দেওচায় নিযুক্ত টিএমসি রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম নিজের ২৬ জন আত্মীয়কে এই প্রকল্পে চাকরি পেতে সাহায্য করেছে। যদিও এরা কেউই প্রকল্পের জন্য নিজেদের জমি দেয়নি।“ সাথে তিনি এই অভিযোগের সাথে কিছু নথিও উপস্থাপন করেন।

পাশাপাশি ভেবে দেখুন, এটা কী সম্ভব যে সরকার কোনও সংস্থাকে প্রকল্পের টেন্ডার দিল, আর রাজ্যের শাসক দল সেই বিষয়ে জানে না। কিংবা হঠাৎ কোনও সংস্থা কী পেয়ে যেতে পারে টেণ্ডার? যদিও এখনও সব কিছুই নির্ভর করছে তদন্তের ওপর।

লাস্ট আপডেট অনুযায়ী, ৮ই নভেম্বর বালি পাচার মামলায় ধৃত অরুণ শরাফের জামিনের আর্জি খারিজ করেছে আদালত। তাকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ইডি হেপাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনার কী মনে হয়, আদেও কী তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ যোগ আছে? নাকি শাসক দলকে অন্ধকারে রেখে বালি পাচার চক্রের এক এবং অদ্বিতীয় কিংপিন ছিলেন অরুণ শরাফ?

Leave a Comment