আজ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন আমাদের সময়ের বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক নীলোৎপল রায় (Nilotpal Roy) যার নতুন মহাকাব্যিক ব্যঙ্গ উপন্যাসটি এই বছরই প্রকাশিত হতে চলেছে জয়েস অ্যাণ্ড কোম্পানী পাবলিশিং সোসাইটি (Joyce and Company Publishing Society) থেকে। তিনি যখন কথা বলেন তখন এই পৃথিবীতে দু’ধরণের মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এক ধরণের মানুষ ভাবে, “এই রে! এই লোকটা এবার এমন সব প্রশ্ন করতে আরম্ভ করবে, যেগুলোর একটারও উত্তর আমার ঠাকুরদারও জানা নেই; এমন সব রেফারেন্স দেবে, যা বাপের জন্মেও কোনোদিন শুনি নি; এই লোকটা মুখ খুললেই আমাদের বেইজ্জত হতে হয়, অসহ্য লোক একটা!”
আরেক ধরণের মানুষ ভাবে, “এই তো, উনি মুখ খুলেছেন! আবার আমরা এমন অনেক কিছু শিখতে পারবো যা আমাদের আর কেউ শেখাতে পারবে না। উনি পাঁচ মিনিট কথা বললে আমরা পাঁচটা এমন নতুন বিষয় জানতে পারবো যা আর কারোর জানা নেই। আমরা ওনার কথা শুনতে চাই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, দিনের পর দিন ধরে, মাসের পর মাস ধরে, বছরের পর বছর ধরে, শুনে যেতে চাই।” আজ ‘ইণ্ডিয়াহুড’-এ তিনি স্বভাবসিদ্ধভাবেই আনকাট, আনসেন্সর্ড।
প্রশ্ন : আপনার নতুন বাংলা উপন্যাস এই বছরই প্রকাশিত হতে চলেছে; মহাকাব্যের আঙ্গিকে এটি লিখতে আপনার ১০ বছরেরও বেশী সময় লেগেছে। এই যে আপনার জীবনের ১০/১১-টা বছর বইটা লিখতে চলে গেলো, এই জার্নিটার অভিজ্ঞতা কেমন?
নীলোৎপল রায় : এইটাই সবচেয়ে সুখকর। এই ১০/১১ বছর ধরে অসম্ভব পরিশ্রম গেছে, শারীরিক ও মানসিক। কিন্তু, সেই ধকলের পর, যখন দুর্বোধ্যতর থেকে দুর্বোধ্যতম এক-একটি বই বারংবার পড়তে পড়তে তার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছি, যখন লেখার সময় কলম থেকে এক-একটি বাক্যের জন্ম হয়েছে, যখন এক-একটি অনুচ্ছেদ লিখে শেষ করেছি, তখন এক অনির্বচনীয় আনন্দ পেয়েছি। এই বইটি লেখা চলাকালীন আমার যেটি কর্মক্ষেত্র ছিলো, সেখানে যেতে-আসতে মোট ৮০ কিলোমিটার পথ আমাকে প্রতিদিন পাড়ি দিতে হতো, এবং তারপর আমাকে লেখার জন্য যা যা করা প্রয়োজন সেগুলি করার সময় বার করে তা করতে হতো। এই এক দশক সময়ে আমি পশ্চিমবঙ্গের মোট ১৫-টি লাইব্রেরীতে মাসের পর মাস কাটিয়েছি; আমাদের রাজ্য সরকারের West Bengal State Archives-এ, এবং আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের Indian National Archives-এ সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে শ’য়ে-শ’য়ে দুর্লভ নথিপত্র ঘেঁটেছি; বছরের পর বছর ধরে দুষ্প্রাপ্যতর থেকে দুষ্প্রাপ্যতম সব গ্রন্থ খুঁজে বেড়িয়েছি ও সংগ্রহ করেছি; এবং সবথেকে ইণ্টারেস্টিং হলো, পশ্চিমবঙ্গের ছ’টি জেলার বিভিন্ন প্রান্তে, দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, চুপ করে বসে থেকেছি — কখনো চায়ের দোকানে, কখনো চুল কাটার সেলুনে, কখনো শ্মশানে, কখনো রিক্সা স্ট্যাণ্ডে, কখনো বাস গুমটিতে, কখনো রেল স্টেশনে, কখনো ট্রাম টার্মিনাসে, কখনো বস্তি এলাকায়, কখনো রেডলাইট পাড়ায়, কখনো বাংলা মদের দোকানের সামনের ফুটপাথে, কখনো রাস্তার ভাতের হোটেলে, কখনো কার পার্কিঙে, কখনো থানার বাইরের রাস্তায়, কখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসের বাইরের রাস্তায় — শুধুমাত্র সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মুখের স্বতঃস্ফূর্ত ভাষা, তাঁদের স্বাভাবিক সংলাপ, তাঁদের কথ্য ডায়ালেক্ট নিজের কানে শোনার ও বোঝার জন্য; পুলিশের আর প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মরত আমার কয়েকজন সহপাঠী, আমার কিছু সাংবাদিক বন্ধু, আমাকে অপরিসীম সাহায্য করেছেন, যাতে এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে গিয়ে আমাকে কোথাও কখনো কোনোরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন না হতে হয়, তা নিশ্চিত করেছেন। তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আর, এই সমস্ত অর্জন, শেষ বিন্দু পর্য্যন্ত নিংড়ে ঢেলে দিয়ে, যখন মহাকাব্যের আঙ্গিকে এই গ্রন্থটি তিল তিল করে আমার নিজের হাতে আমি গড়ে উঠতে দেখি, তখন একটা অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করি। সব মিলিয়ে, এ এমন এক অভিজ্ঞতা যা আমৃত্যু আমাকে এটা মনে করিয়ে দেবে, যে এই ১০-টা বছর আমার লেখক-জীবনের উর্বরতম পৰ্য্যায়গুলির মধ্যে অন্যতম একটি।
প্রশ্ন : আপনি এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘উৎসন্নে যাওয়া বাঙালী জাতিকে’ — এটা কেমনধারা উৎসর্গ?
নীলোৎপল রায় : হ্যাঁ। বাঙালী জাতির সম্পর্কে ১৩০৩ বঙ্গাব্দে, মানে ১৮৯৬ সালে, কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস লিখেছিলেন : “গু মাখিয়া মারি ঝাঁটা যত মনে লয়! / বাঙ্গালী মানুষ যদি, প্রেত করে কয়?” আবার, ১৯৮৮ সালে, নীরদ সি. চৌধুরী লিখছেন : “আজ বাঙালী জীবনে যে জিনিসটা প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ … জাতির মৃত্যুশয্যার চারিদিকে ধনগর্বে উল্লসিত বাঙালী প্রেত ও প্রেতিনীর নৃত্য।” আজকে ২০২৪ সালে এসে সেই কথাগুলো আরো জ্বলন্ত সত্য হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের চারপাশে, প্রতি মুহূর্তে। নিজে একজন বাঙালী হিসেবে আমি এটা মেলাতে পারছি না; যে বাঙালী জাতি একটা সময় মেধায়-মৰ্য্যাদায়-গৌরবে-শ্রেষ্ঠত্বে সকলের শীর্ষে ছিলো, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে গুণে-মানে অন্য সবার চোখে শ্রদ্ধার তথা সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলো, সেই বাঙালী জাতি এখন মননহীন-কৃষ্টিহীন-দীক্ষাহীন নিম্নরুচির আর নিম্নমানের মাঝারিয়ানা উদযাপনে মেতেছে। নীরদবাবুর বক্তব্যটা একটু গভীরভাবে ভাবার এবং বোঝার চেষ্টা করুন — মানে, বাপ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে অন্তিম মুহূর্ত গুনছে, আর ছেলেমেয়েরা তার পাশে উল্লাসে ফেটে পড়ে প্রেত-প্রেতিনীর মতো নাচছে, যে বুড়ো মরলেই তার সমস্ত বিষয়সম্পত্তির মালিক হবো আমরা — এটা যেমন ও যতখানি লজ্জার-ঘেন্নার-দুঃখের পরিস্থিতি, বাঙালী জাতির বর্তমান অবস্থাও ঠিক সেইরকমই লজ্জার-ঘেন্নার-দুঃখের। নিজে একজন বাঙালী হিসেবে আমি মনেপ্রাণে এটা চাই যে বাঙালী নিজেদের এই অধঃপতনের নর্দমা থেকে তুলে আনুক, এবং পুনরায় নিজেদেরকে একটি জাতি হিসেবে আগের সেই গৌরবময় মৰ্য্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করুক; কিন্তু, সেটা ততক্ষণ সম্ভব নয়, যতক্ষণ না বাঙালী নিজে এটা অনুধাবন করছে, যে তাদের চরম অধঃপতন ঘটেছে। তাই, আমার এই গ্রন্থটিকে বলতে পারেন সমকালীন বাঙালী জাতির পাছায় কষিয়ে মারা একটি লাথি, প্রতীকীভাবে, সমকালীন বাঙালী জাতির গালে সপাটে মারা একটি থাপ্পড়, প্রতীকীভাবে; তাদের ভালোর জন্যই মারা, যাতে এই লাথিটি খেয়ে তাদের চৈতন্যোদয় হয়, যাতে এই থাপ্পড়টি খাওয়ার পর লাল হয়ে যাওয়া গালে হাত বুলোতে বুলোতে বাঙালী জাতি নিজেদের সংশোধন করার প্রয়োজন অনুভব করে, এবং আন্তরিকভাবে ও সততার সঙ্গে নিজেদেরকে শুধরাবার প্রচেষ্টাটা করে। তারা যে ইতিমধ্যেই উৎসন্নে গেছে, তা বোঝানোর জন্যই এহেন উৎসর্গপত্র।
প্রশ্ন : বাঙালী বই পড়ে এখন? কী মনে হয় আপনার?
নীলোৎপল রায় : খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। তবে, এই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার আগে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, আচ্ছা আপনি বলুন তো, আপনার প্রতিবেশীদের মধ্যে কতজন এমন মানুষকে আপনি জানেন যারা নিয়মিত লাইব্রেরীতে যান? আপনার সহকর্মীদের মধ্যে কতজন এমন মানুষকে আপনি জানেন যারা নিয়মিত লাইব্রেরীতে যান? আপনার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কতজন এমন মানুষকে আপনি জানেন যারা নিয়মিত লাইব্রেরীতে যান? আপনার স্কুলের ও কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে কতজন এমন মানুষকে আপনি জানেন যারা নিয়মিত লাইব্রেরীতে যান? আপনার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে কতজন এমন মানুষকে আপনি জানেন যারা নিয়মিত লাইব্রেরীতে যান? আমার এই প্রশ্নগুলির উত্তর ভাবার চেষ্টা করলেই, আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে পরিস্থিতিটা এখন কী করুণ! আসলে, এই বই পড়া ব্যাপারটা না এতটা সহজ আদৌ নয়, যতটা সহজ বলে সেটাকে ভাবা হয়, বা দেখানো হয়। আমি কিন্তু সিলেবাসের বই পড়ার কথা একেবারেই বলছি না। সিলেবাসের পড়াশোনা বেসিক্যালী আমাদের কূপমণ্ডুক বানিয়ে রাখার কল; যে কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা যত বড় ডিগ্রীধারী হই, আসলে তত বড় কূপমণ্ডুক হয়ে উঠতে থাকি; সিলেবাসের বই যত বেশী পড়ি, তত বেশী মূর্খ হয়ে উঠতে থাকি। সিলেবাসের বাইরের লেখাপড়াটা কিন্তু অন্যরকম, এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সিলেবাসের বাইরের বইপত্র যখন আপনি পড়তে আরম্ভ করবেন, তখন কী কী ঘটবে? প্রথম দশটি বই পড়ার পর আপনার মনে হবে, যে আপনি বেশ জ্ঞানী হয়ে উঠেছেন। পঞ্চাশটি বই পড়ার পর আপনার মনে হবে, যে আপনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন পড়ুয়া হয়ে উঠেছেন। দু’শোটি বই পড়ার পর আপনার মনে হবে, আপনি এত পড়ে ফেলেছেন যে এবার আপনি ইচ্ছে করলেই লেখক হয়ে যেতে পারেন। পাঁচশোটি বই পড়ার পর আপনার উপলব্ধি হবে, যে এই প্রথমবার আপনি নিকৃষ্ট বই আর উৎকৃষ্ট বইয়ের তফাৎ বুঝতে শিখতে শুরু করেছেন। এক-হাজার বই পড়ার পর আপনি অনুধাবন করবেন, যে আপনার চারপাশে যত পড়ুয়া মানুষ রয়েছেন তাঁদের মধ্যে নিরানব্বই শতাংশই এখনো নিকৃষ্ট বই আর উৎকৃষ্ট বইয়ের তফাৎ বুঝতেই শেখেন নি। দেড়-হাজার বই পড়ার পর আপনি অনুভব করবেন, যে ছেলেবেলা থেকে যেসব লেখকদের নাম আপনি মস্ত বড় লেখক বলে শুনে এসেছেন, জেনে এসেছেন ও বুঝে এসেছেন, তাঁরা আসলে অত্যন্ত নিম্নমানের লেখক এবং তাঁদের লেখাপত্র এত নিকৃষ্ট যে সেগুলিকে আদৌ ‘সাহিত্য’ পদবাচ্য বলে গণ্য করাই যায় না। দু’-হাজার বই পড়ার পর আপনি বুঝতে পারবেন, যে প্রকৃত অর্থে একজন উৎকৃষ্ট মানের লেখক হয়ে উঠতে পারা, পৃথিবীর কঠিনতম কাজ। তবে খেয়াল রাখতে হবে, পাতার পর পাতা উল্টে নিছকই গড়গড় করে পড়ে গেলেই হবে না, আপনার পঠন-ক্রিয়াটি অতি অবশ্যই হতে হবে অনুসন্ধিৎসু তথা ব্যবচ্ছেদমূলক তথা বিশ্লেষণধর্মী; অর্থাৎ, প্রতিটি পৃষ্ঠার, প্রতিটি অনুচ্ছেদের, প্রতিটি বাক্যের, প্রতিটি শব্দের, এবং এমনকি প্রতিটি যতিচিহ্নের অবধি চামড়া ছিঁড়ে, মাংস খুঁড়ে, হাড় ফুঁড়ে, অস্থিমজ্জার ভিতরে সেঁধিয়ে যেতে যেতে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে সেগুলির নিগূঢ় অর্থদ্যোতনা, কূটাভাস, দ্বান্দ্বিকতা, প্রতীকীময়তা, রূপকধর্মীতা ইত্যাদি সবকিছু। সেটাই হলো প্রকৃত অর্থে বই পড়া।
প্রশ্ন : আচ্ছা, এই বাঙালী প্রসঙ্গেই, আপনার সমসাময়িক তিনজন বাঙালী সম্পর্কে যদি আপনার অভিমত জানতে চাই এক-এক করে? প্রথমজন সাহিত্যিক, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য।
নীলোৎপল রায় : বর্তমান সময়ের তৃতীয় সবচেয়ে আণ্ডাররেটেড লেখক।
প্রশ্ন : দ্বিতীয়জনও সাহিত্যিক, রোদ্দূর রায়।
নীলোৎপল রায় : বর্তমান সময়ের দ্বিতীয় সবচেয়ে আণ্ডাররেটেড লেখক।
প্রশ্ন : প্রথমটা তাহলে কে?
নীলোৎপল রায় : (হেসে) কী জানি! এই মুহূর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না নামটা।
প্রশ্ন : তৃতীয়জন সাহিত্যিক নন, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
নীলোৎপল রায় : নমস্য বাঙালী। তাঁর রাজনৈতিক মত বা অবস্থান আমার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর হতেই পারে, কিন্তু বাঙালীর ইতিহাসে তাঁর নাম থেকে যাবে — যদিও বাঙালী এখন ইতিহাসবিস্মৃত জাতি হয়ে গেছে — তিনি এক অত্যন্ত কঠিন সময়ে বাঙালীকে নতুন করে নিজের শিরদাঁড়া খুঁজে নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। প্রথমতঃ, উনি একজন যথার্থ ভদ্রলোক; আর দ্বিতীয়তঃ, যে ঐকান্তিক সততা নিয়ে উনি white collar criminals-দের দুর্নীতির দিকে আঙ্গুল তুলে, তাদের উল্টোদিকে নিজের ঋজু মেরুদণ্ডটি সোজা রেখে দাঁড়িয়েছেন, তার জন্য উনি আমার শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন। মনে রাখবেন, যে tainted hooligans বা দাগী গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে কথা বলা অনেক সহজ; কিন্তু, white collar criminals ওরফে সাধুবেশী অপরাধীদের মৌচাকে ঢিল মারার মতো দুঃসাহসিক কাজ করতে হলে ইস্পাত-কঠিন শিরদাঁড়া থাকতে হয়। সেটি ওনার আছে।
প্রশ্ন : এবার, আপনার সমসাময়িক নন, এমন একজন বাঙালী — রবীন্দ্রনাথ?
নীলোৎপল রায় : বাঙালী তাঁকে আজও প্রকৃত অর্থে বুঝতেই পারে নি, গুরুদেব বানিয়ে তাকে তুলে রেখে দিয়েছে। ওনার মতো বড় মাপের বিপ্লবী বাঙালী সমাজে খুবই কম জন্মেছে। সেই প্রতিবাদী সত্ত্বাটাকে বাঙালী চিনতেই পারে নি, ন্যাকা ন্যাকা গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে লোকটাকে ভগবান বানিয়ে ফেলেছে। আর, নিজেদের যে একটা শিরদাঁড়া আছে, সেটা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে। উনি আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচাবার কথা বলেছিলেন; আমার নতুন বইটিতে আমি সেই কাজটিই করার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : আপনার আদর্শ বাঙালী কে? মানে, লেখক হিসেবে নয়, ব্যক্তি হিসেবে? যদি একটিমাত্র নাম বেছে নিতে হয়!
নীলোৎপল রায় : নীরদ চন্দ্র চৌধুরী।
প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথ নন কেন?
নীলোৎপল রায় : ভেরি সিম্পল। নীরদবাবু রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক অনেক অনেক বড় মাপের মানুষ, বড় মাপের লেখক, এবং বড় মাপের চিন্তাবিদ। বাঙালী নীরদবাবুকে বুঝতেই পারে নি, তাঁর লেখা পড়েই নি, তাই তাঁর আকাশছোঁয়া প্রতিভা সম্পর্কে বাঙালী সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার হলো বাঙালী রবীন্দ্রনাথের লেখাও ঠিকমতো পড়ে নি। অথচ, তবুও কিছু না বুঝেই তাঁকে ঈশ্বর বানিয়ে ফেলেছে, বাঙালী জাতির সবচেয়ে বড় অন্ধ আবেগ বানিয়ে রেখেছে। শুধুমাত্র লোকটা নোবেল পেয়েছিলো বলে — ১৯১৩ সালে নোবেল পাওয়ার আগে অবধি রবীন্দ্রনাথের সমকালীন বাঙালী সমাজ লোকটাকে তেড়ে গালিগালাজ করেছে — ঐ পুরস্কারটা না পেলে বাঙালী রবীন্দ্রনাথকেও মনে রাখতো না। এখনো বাঙালী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বেসিক্যালী কিছুই জানে না। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে আরবিট্রারিলী আপনি ৫০ জন মানুষকে ধরে জিজ্ঞাসা করুন তো, রবীন্দ্রনাথের জন্মসাল আর মৃত্যুসাল কত — একজনও বলতে পারবে না, জানে না। স্কুলের আর কলেজের পাঠ্যবইতে যেটুকু আছে, সেইটুকু ছাড়া এক লাইন রবীন্দ্রনাথও পড়া নেই এখনকার ৯৯ শতাংশ বাঙালীর। সিলেবাসে যতটুকু রবীন্দ্রনাথ আছে, ততটুকুই তাঁর সম্পর্কে জানে বাঙালী। আর, যতটা ভক্তি বাইরে দেখায়, আসলে ততটা ভক্তি রবীন্দ্রনাথকে বাঙালী মোটেও করে না। এই তো, মাত্র দু’মাস আগে আমি শিলং গিয়ে দেখে এলাম, সমস্ত ট্যুরিস্ট স্পটে প্রচুর বাঙালী ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ শিলং-এ রবীন্দ্রনাথের যে বাংলোটি আছে, যেটিকে মেঘালয় রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করে এখন তাঁর নামাঙ্কিত আর্ট গ্যালারী বানিয়েছে, সেটি শ্মশানের মতো খাঁ খাঁ করছে, একজনও ট্যুরিস্ট যায় না সেখানে। আমাকে আর আমার স্ত্রীকে দেখে সেখানকার কর্মচারীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিলেন, এটা ভেবে যে এখানে কেউ কখনো আসে না, এনারা এখানে কী করতে এসে হাজির হলেন! অথচ, এখানে আসা তো বাঙালীর তীর্থক্ষেত্র দর্শনের মতো হওয়া উচিত, যদি সত্যি রবীন্দ্রনাথকে বাঙালী ভগবান মনে করে। তো এই বাঙালী জাতি নীরদবাবুকে বুঝবে বা চিনবে বা জানবে কেমন করে? নীরদবাবু বাঙালী জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ থিঙ্কার, তাঁর ধারেকাছে কেউ নেই। রবীন্দ্রনাথও না। এই সহজ সত্যি কথাটা বলতে বা মেনে নিতে অসুবিধাটা কোথায়!
প্রশ্ন : বর্তমান সময়ের বাঙালী জাতির সমস্যাটা কোথায়?
নীলোৎপল রায় : বাঙালী জাতির মধ্যে “গভীর মানুষ” এখন লুপ্তপ্রায়। অর্ধশিক্ষিত বাঙালী সাংবাদিকরা প্রতিদিন সকালে মাতৃভাষার সারবত্তাহীন খবরের কাগজের পাতায় লাইনে লাইনে বাংলা বানান ভুল লিখছেন; অথচ বাঙালী সংবাদপত্র-পাঠকরা ততোধিক অশিক্ষিত হওয়ায়, তা আদৌ ধরতেই পারছেন না! অর্ধশিক্ষিত বাঙালী জনপ্রতিনিধিরা রোজ সন্ধ্যায় বাংলা খবরের চ্যানেলের মেধাহীন বিতর্কসভায় কলতলার খিস্তিখেউড় করছেন; অথচ বাঙালী ভোটার-দর্শকরা ততোধিক অশিক্ষিত হওয়ায়, তা দেখে বিন্দুমাত্রও লজ্জা পাচ্ছেন না, বরং মজায় হাততালি বাজাচ্ছেন! অর্ধশিক্ষিত বাঙালী লেখক-লেখিকারা তিনশো’-পঁয়ষট্টি-দিন-চব্বিশ-ঘণ্টা উদোম সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহিত্যের নামে মাঝারিয়ানার গু-মুৎ-বমি ঢেলে যাচ্ছেন; অথচ বাঙালী পাঁঠক-পাঁঠিকারা ততোধিক অশিক্ষিত হওয়ায় তা না বুঝেই সেসবকে অসাধারণ সাহিত্য বলে চাটতে চাটতে মাথায় তুলে নেত্য করে চলেছেন। প্রায় গোটা বাঙালী জাতটাই এখন একটা মননশূন্য-গভীরতাহীন-রুচিশীলতারহিত প্রজাতিতে পর্য্যবসিত হয়েছে! এই আত্মঘাতী আদিখ্যেতাপ্রবণতার দু’টি প্রধান কারণ হলো “মূর্খের আত্মবিশ্বাস” এবং “মেরুদণ্ডহীনতার ঔদ্ধত্য”, যেগুলির জন্ম হয় যথেষ্ট পড়াশোনার অভাব থেকে; ডিগ্রীপ্রাপ্তির প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার অভাব নয়, সিলেবাসের বাইরের সীমাহীন পাঠ-অভ্যাসের অভাব। ধরুন, আপনি তিরিশ ফুট লম্বা একটি তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন, আর আপনার অর্ধেক জীবন ধরে বলে চলেছেন : “কী বিশালতা! কী উচ্চতা! কী অসাধারণত্ব!” এটাই হলো “মূর্খের আত্মবিশ্বাস”। এইবার ধরুন, কেউ একজন এসে আপনাকে বললেন : “আচ্ছা ভাই, আপনি কি রডোডেনড্রন দেখেছেন? আপনি কি কখনো শুনেছেন যে এই নামে এক ধরণের গাছ আছে? আপনি কি জানেন যে ঐ প্রজাতির গাছের উচ্চতা কত হয়?” আপনি মনে মনে বিজ্ঞের মতো হেসে ভাবলেন : “রডোডেনড্রন গাছ কত বড় হতে পারে? এই তিরিশ ফুট তালগাছের চেয়ে বেশী তো নয়!” আপনার ঐ “মূর্খের আত্মবিশ্বাস” আপনাকে বুঝতেই দিলো না, যে মিডিওকার লেখক-কবিদের অসাধারণ লেখক-কবি বলার বা ভাবার অর্থ হলো এই, যে আপনার মেধা, বুদ্ধি, ও পড়াশোনা, তিনটেই খুবই কম; এবং আপনার দুনিয়াটা যাচ্ছেতাই রকমের ছোটো। মানে, আপনি আসলে একটা অগভীর-অপরিসর-অপ্রশস্ত এঁদো নর্দমায় থাকেন, যেখানে কেবলই মাত্র কিছু কেঁচো আর জলঢোঁড়া সাপ ছাড়া কিছু থাকে না বলে, আজ অবধি আপনি জীবনে অন্য কিছু দেখেই উঠতে পারেন নি; এবং অ্যানাকোণ্ডা নামে যে এক প্রজাতির সাপ আছে, তা যেহেতু আপনি কখনো শোনেনই নি, তার আকার-আয়তন-বিপুলতা সম্পর্কে আপনার বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই, ও আপনার কাছে বিশালত্বের সর্বশেষ তথা বৃহত্তম মাপকাঠি হলো ঐ জলঢোঁড়াই। “মেরুদণ্ডহীনতার ঔদ্ধত্য” হলো আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার স্রোতে স্বীয় বোধ-বুদ্ধি-বিচার-বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে গা ভাসানো, কেননা তা নিরাপদ; মানে, ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জন যা বলছেন তা ভুল হলেও সেদিকেই দাঁড়িয়ে সেই পক্ষের হয়েই যুক্তিহীনভাবে গলাবাজি করা; যেদিকে দল ভারী, সেদিকের ভীড়ের নিরাপত্তা বলয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে আস্ফালন করা। স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে সঠিক কথা বলতে গেলে নিজস্ব একটি ঋজু শিরদাঁড়া প্রয়োজন; যা না থাকার কারণে অপ্রিয় ও অপ্রীতিকর সত্য কথা, নিজে বলার তো প্রশ্নই নেই, এমনকি অন্য কেউ বললেও তা স্বীকার করার বা মেনে নেওয়ার সৎ সাহসটুকু অবধি আজ বাঙালী হারিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ, ডিটেকটিভ দীপক-চ্যাটার্জীর স্রষ্টা স্বপনকুমার বাংলা সাহিত্যের গাঁজাখুরি লেখক সেকথা বলে মজলিস ফাটিয়ে দিয়ে বাহাদুরি নেওয়া যায়; কিন্তু, ফেলুদা-কাকাবাবু-কিরীটি-ব্যোমকেশ হাগা সত্যজিৎ-সুনীল-নীহাররঞ্জন-শরদিন্দুও যে এক্কেবারে হুবহু একই গোত্রের খাজা কলমকুমার, এই চরম অপ্রিয় সত্য কথাটি বলার হিম্মৎ বাঙালীর আজ নেই; বরং, উল্টে, ঐ “মেরুদণ্ডহীনতার ঔদ্ধত্য” নিয়ে অর্ধশিক্ষিত বাঙালী সত্যজিৎ-সুনীল-নীহাররঞ্জন-শরদিন্দুকে বিরাট মাপের সাহিত্যিক বলে ডিফেণ্ড করে, তাঁদের নিয়ে চরম ন্যাকাপনা ও আদেখলামো করে, যেহেতু সেদিকেই পাল্লা ভারী। এটাই হলো “মেরুদণ্ডহীনতার ঔদ্ধত্য”। বিপরীতে দাঁড়িয়ে এককভাবে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করে প্রতর্ক গড়ে তুলতে হলে যে মানের ও যে স্তরের পড়াশোনা থাকা দরকার, তা নেই বলেই হেন মেধাদৈন্য। আসলে, বাঙালী বর্তমানে একটি আত্ম-সম্ভ্রমহীন চ্যাংড়া, ছ্যাবলা, ও ছ্যাঁচড়া, নন-এলিট “ছোটলোক” জাতিতে পরিণত হয়েছে, এবং তাঁরা কাছাখোলা রকমের নির্লজ্জ হয়ে পড়েছে। নন-এলিট মানুষদের আমি অপছন্দ করি না; কিন্তু, তাঁদের যাবতীয় চ্যাংড়ামো-ছ্যাবলামো-ছ্যাঁচড়ামোর পরিপন্থী আমি; কেননা, “ছোটলোক” হওয়াটা গর্বের বিষয় নয়। বাঙালী অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে ‘sorry’ শব্দটি বলা আয়ত্ত করে নিয়েছে, কিন্তু ‘please’ শব্দটি বলা শিখে উঠতে পারে নি, আর ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি তো বাঙালীর অভিধান থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আচ্ছা, আপনি বলুন তো, ক’জন বাঙালী রিক্সা বা অটো বা টোটো বা ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে তার চালককে হাসিমুখে সবিনয়ে প্রতিবার ‘ধন্যবাদ’ বলেন? ক’জন বাঙালী ট্রেনের-মেট্রোরেলের-বাসের টিকিট কেটে কাউণ্টারের কর্মীকে বা কণ্ডাক্টরকে হাসিমুখে সবিনয়ে প্রতিবার ‘ধন্যবাদ’ বলেন? ক’জন বাঙালী পাড়ার মাছবিক্রেতাকে-সব্জিবিক্রেতাকে-ফলবিক্রেতাকে-ফুলবিক্রেতাকে-মুদিকে কেনাকাটার পর হাসিমুখে সবিনয়ে প্রতিবার ‘ধন্যবাদ’ বলেন? ক’জন বাঙালী ধোপাকে-নাপিতকে-মুচিকে-মেথরকে দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নেওয়ার পর পারিশ্রমিক দিয়ে হাসিমুখে সবিনয়ে প্রতিবার ‘ধন্যবাদ’ বলেন? ক’জন বাঙালী রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে কিংবা নাটক বা চলচ্চিত্র দেখতে গেলে, তাঁর টেবিলে খাবার পরিবেষণকারী মানুষটিকে বা প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তরে তাঁকে আসন দেখিয়ে দেওয়া মানুষটিকে হাসিমুখে সবিনয়ে প্রতিবার ‘ধন্যবাদ’ বলেন? ইউরোপ বা আমেরিকার মানুষ কিন্তু বলেন; প্রতিবার বলেন। এটা তাঁদের সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক অভ্যাস, সামাজিক সৌজন্য। আমিও এটা তাঁদের কাছ থেকেই শিখেছি। কিন্তু, বাঙালী এখন এই বেসিক ভদ্রতাটাই ভুলে গেছে।
প্রশ্ন : আপনি “ছোটলোক” শব্দটা এইভাবে বলছেন? আপনার দিকে তো “রে রে” করে তেড়ে আসবে সবাই!
নীলোৎপল রায় : “রে রে” করে লাফিয়ে উঠে তেড়ে আসার কিছু নেই; “ছোটলোক” শব্দটি আমি সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি এবং করি। যারা এসব শুনলেই প্রবল প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন — এর চেয়ে অনেক বেশী গুরুতর অন্য অনেক কিছুতে প্রতিবাদী না হলেও — তাঁরা আসলে “ছোটলোক” শব্দটির প্রকৃত অর্থ জানেনই না। আগে ভালো করে বুঝুন, “ছোটলোক” শব্দের বিপরীত শব্দ কিন্তু “বড়লোক” নয়; “ছোটলোক” শব্দের বিপরীত শব্দ হলো “ভদ্রলোক”। কারো উপার্জনসীমা বা পেশা-বৃত্তি-জীবিকা অনুযায়ী নির্ধারণ করা যায় না যে তিনি “ছোটলোক” কিনা, তা উচিতও নয়; যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই এইরকম ভুল ভাবেন এবং এইরকম ভুলভাবে বিচার করেই কিছু মানুষকে “ছোটলোক” বলে দেগে দেন। একজন রিক্সাচালক কিংবা মাছবিক্রেতা কিংবা ধাঙ্গড়ও পরম “ভদ্রলোক” হতে পারেন — নাও হতে পারেন; আবার, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অথবা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অথবা উচ্চপদস্থ আমলাও চরম “ছোটলোক” হতে পারেন — নাও হতে পারেন। কেউ বিত্তসম্পদে বা সামাজিক অবস্থানে বা পদমর্যাদায় বা প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীপ্রাপ্তিতে পিছিয়ে আছেন মানেই তিনি “ছোটলোক” নন; “ছোটলোক” আসলে তাঁরাই যারা নিজেদের ব্যবহারে অসংযত, চিন্তাভাবনায় উগ্র, মানসিকতায় ইতর, অর্থাৎ যারা প্রকৃত ভদ্রতা জানেন না, যারা অভব্য-অশিষ্ট-অসভ্য। আমাদের প্রত্যেকের চারপাশে এরকম অসংখ্য ধনী-কেউকেটা-মাতব্বর-উচ্চডিগ্রীধারী “ছোটলোক” আছেন, — তাঁরা সাক্ষর, কিন্তু শিক্ষিত নন, কারণ শিক্ষিত হওয়া আর ডিগ্রীধারী হওয়া এক নয়, — আপাতঃদৃষ্টিতে যাদের কথাবার্তা-পোশাকআশাক-আচারব্যবহার দেখলে “ভদ্রলোক” বলে ভুল হয়। কিন্তু, আসলে যে তাঁরা “ছোটলোক” তা অচিরেই স্পষ্ট হয়ে যায় তাঁদের রুচিশীলতার অভাব, অসম্ভ্রান্ত আচরণ, ও সংকীর্ণমনা চরিত্র দেখে; তাঁদের অগভীর আড্ডা, ফাঁপা বৈঠক, ও তরল আলোচনা শুনে; তাঁদের ভাবনার সীমাবদ্ধতা থেকে, চিন্তার বাক্সবন্দীত্ব থেকে, মানসিকতার কূপমণ্ডুকত্ব থেকে। স্থূল গপ্পো-গুজব, মোটা দাগের রসিকতা, চটুল ভাঁড়ামো, এসব এঁদের অসম্ভব প্রিয়; আর এগুলি সবই হলো “ছোটলোকামি”। আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগে রাস্তাঘাটে আপনার-আমার চারপাশের রিকশাচালক-অটোচালক-মাছবিক্রেতা-সব্জিবিক্রেতারা নিজেদের মধ্যে রঙ্গরসিকতা করে মুখ খারাপ করলেও, সামনে মহিলা বা শিশু দেখলে তৎক্ষণাৎ নিজেদের মুখ সামলে নিতেন; কিংবা অত্যন্ত সাধারণ একটি চুল কাটার সেলুনে, বা ফুটপাথের চায়ের দোকানে, অথবা পাড়ার মোড়ের সিগারেটের দোকানে, খদ্দের না থাকলে আড্ডারত জমায়েতটি নিজেদের মধ্যে ঠাট্টাতামাশা করে অল্পবিস্তর গালিগালাজ করলেও, কোনো বয়স্ক বা মধ্যবয়স্ক এমনকি অচেনা পুরুষ-মহিলা এসে দাঁড়ালেও সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিজেদের ভাষা সংযত করে নিতেন; আর অসাবধানতাবশতঃ মুখ ফস্কে কোনো অপশব্দ অনিচ্ছাকৃতভাবে বলে ফেললে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতেন; কেননা, তাঁরা পুঁথিগতভাবে কম শিক্ষিত হলেও তাঁদের মধ্যে এই সামাজিক শিক্ষা ও নৈতিকতাবোধ সম্পূর্ণ মাত্রায় বজায় ছিলো যে রাস্তাঘাটে অন্য মানুষের সামনে, বিশেষ করে মহিলাদের ও শিশুদের সামনে কখনোই মুখ খারাপ করতে নেই, এতে তাঁদের অসম্মান হয়; অর্থাৎ, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উচ্চতম ডিগ্রী না থাকলেও তাঁদের পূর্ণ মাত্রায় সহবৎবোধ ছিলো; সুতরাং, নন-এলিট হলেও তাঁরা ছিলেন প্রকৃত অর্থেই সভ্য নাগরিক, ভদ্র মানুষ, তাঁরা জানতেন শিষ্টাচার কাকে বলে, এবং তাঁরা কোনোভাবেই “ছোটলোক” ছিলেন না; এই ধরণের সমাজসচেতনতাসম্পন্ন নন-এলিট মানুষদের আমি শ্রদ্ধা করি। অথচ, এখন চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, রিকশাচালক-অটোচালক-মাছবিক্রেতা-সব্জিবিক্রেতাদের একাংশ অম্লান বদনে, দিব্যি মহিলাদের সামনে, শিশুদের সামনে, বয়স্ক মানুষদের সামনে অবাধে মুখ খারাপ করছেন, অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তিখেউড় করছেন, এবং এর জন্য তাঁরা বিন্দুমাত্রও লজ্জিত বোধ করছেন না! রাস্তাঘাটে, পাবলিক প্লেসে, বাসে-ট্রেনে, হাটে-বাজারে অধিকাংশ মানুষ মুখ খুললেই ‘ব’ আর ‘চ’-এর ছড়াছড়ি, প্রতিটি শব্দে প্রতিটি বাক্যে খিস্তির ফুলঝুরি ছুটছে! এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরাও এর বাইরে নন! আজ থেকে ২৫ বছর আগে বাঙালী সমাজের ছবিটা এরকম ছিলো না। কিন্তু এখন এটাকে তাঁরা কোনো অসভ্যতা বা অভব্যতা বলে মনেই করছেন না, কারণ মানুষকে মানুষ হিসেবে সমীহ করার শিক্ষা তাঁদের মধ্যে অবলুপ্ত হয়েছে!! শিষ্টাচার কাকে বলে সেই বোধই এঁদের নেই!!! ইউটিউবে-ফেসবুকে চোখ রাখলেই যে এক শ্রেণীর বাঙালী কর্তৃক ইতরামিপূর্ণ ছোটলোক-সংস্কৃতির আস্ফালন দেখে আজ লজ্জায়-ঘৃণায়-গ্লানিতে শিহরিত হতে হচ্ছে, সেই শ্রেণীটিই হলো বর্তমান বাঙালী সমাজের “ছোটলোক” শ্রেণী।
প্রশ্ন : মানে, আপনি বলছেন যে শিক্ষিত মানুষও ছোটলোক হতে পারে?
নীলোৎপল রায় : “হতে পারে” না, “হয়”। বছরের পর বছর ধরে, আমি দেখেছি, স্বাধীনতার পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হাবড়ার একটি নামকরা স্কুলের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষককে যিনি “attendance” শব্দটির সঠিক বানানটি জানেন না, বেশ কয়েকটি ইংরাজী মাসের নাম সঠিকভাবে বানান করে লিখতে পারেন না, এমনকি মাতৃভাষায় একটি আবেদনপত্র লিখলে বাংলা ভাষাতে বাক্যের ব্যাকরণগত গঠন শুদ্ধভাবে লিখতে পারেন না — আমার কাছে প্রমাণ আছে, কেউ দেখতে চাইলে দেখাতে পারি; অথচ, প্রতি কথায় কথায় নিজেকে বিশাল মাপের শিক্ষিত ও অন্য সকলকে মূর্খ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, এবং মাস গেলে প্রায় এক লক্ষ টাকা বেতন নেন সরকারী কোষাগার থেকে; এই ধরণের মাষ্টারমশাইরা হলেন প্রকৃত অর্থে “ছোটলোক” এবং বর্তমান বাঙালী সমাজের লজ্জা তথা শিক্ষককুলের কলঙ্ক। আবার আমি এও দেখেছি, হাইকোর্টের এক স্বনামধন্য উকিলকে যিনি নিজেকে এতবড় সেলিব্রিটি ভাবেন যে সময়াভাবের অজুহাত দেখিয়ে মক্কেলদের ফোন ধরেন না, অথচ নিউজ চ্যানেলের ক্যামেরার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুটেজ খান; বামপন্থী এই বোদ্ধাটি ক্যামেরার সামনে সততার রাজনীতি করেন বলে বড়াই করেন, অথচ তিনি নিজে এমন সৎ যে মক্কেলদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক হিসেবে যে অর্থ নেন মক্কেলদের তার কোনো রসিদ দেন না; ইনি সাংসদ হওয়ার লোভে নিজের কমরেড জ্যাঠাকে ধরে মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার টিকিট জোগাড় করে ফেলেছেন, কিন্তু আসলে এতখানি অর্ধশিক্ষিত যে ইংরাজীতে একখানা লিগ্যাল নোটিসের খসড়া করতে গেলে তার মধ্যে প্রায় প্রতিটি বাক্যই ব্যাকরণগতভাবে অশুদ্ধ লেখেন — আমার কাছে এরও প্রমাণ আছে, কেউ দেখতে চাইলে দেখাতে পারি; এই ধরণের উকিলরা তথা বামপন্থীরা হলেন প্রকৃত অর্থে “ছোটলোক” এবং বর্তমান বাঙালী সমাজের লজ্জা তথা আইনজীবীকুলের ও সি.পি.এম. দলের কলঙ্ক। এঁরাই হলেন প্রকৃত অর্থে “ছোটলোক” এবং বর্তমান বাঙালী সমাজের লজ্জা তথা কলঙ্ক। অথচ, কী আশ্চর্য্যের ব্যাপার, এই বেহায়াপনা যারা করছেন, আজকের বাঙালী সমাজের তথাকথিত প্রথম সারির মিডিয়াকুল তাঁদেরকেই “হে মহামান্য” বলে সম্বোধন করে, তাঁদেরই মুখে-বুকে-পোঁদে প্রচারের আলো ফেলে, তাঁদেরকেই “বিশিষ্ট বাঙালী” তথা “সোশ্যাল আইকন” বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে; আর আজকের অর্ধশিক্ষিত বাঙালী জাতিও সেইসব পাউডার মাখা বেবুনদেরকেই ভগবানের বাচ্চা মনে করে উল্লাসে ফেটে পড়ে, তাঁদের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে।
প্রশ্ন : আপনার নতুন উপন্যাসের ভূমিকাটির শিরোনাম আপনি দিয়েছেন ‘নান্দীমুখ : ঢ্যামনামির সার্কাস’ — এরকম নাম কেন?
নীলোৎপল রায় : বাঙালী জাতি এখন অলরেডি চিতায় উঠে বসে আছে। অন্তর্জলী যাত্রা চলছে। একটা গোটা জাতি ছোটলোকে পরিণত হয়েছে। সবাই নিজেকে বিরাট কেউকেটা ভাবতে শুরু করেছে; আর, প্রকৃত গুণী মানুষদের সম্মান করা দূরে থাক, চিনতেই পারছে না কেউ। আসলে, কুশিক্ষা যখন সমাজের সর্বস্তরে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে, তখন এমনটা হয়। একটা জাতি যখন নিজেদের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে, ও নিজেদের মাতৃভাষা শেখার প্রয়োজন মনে করে না, নিজেদের ইতিহাসকে অবহেলা করে, ও নিজেদের ইতিহাস জানার আগ্রহ বোধ করে না, নিজেদের ঐতিহ্যকে অশ্রদ্ধা করে, ও নিজেদের ঐতিহ্য পরম্পরাক্রমে ধরে রাখার চেষ্টা করে না, তখন সেই জাতি আত্মঘাতী হয়ে পড়ে। এখনকার বাঙালী বাপ-মায়েরা নিজেদের সন্তানদের বাংলা-মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করাতে লজ্জা পায়, গুরুজনদের প্রণাম করতে শেখায় না। এইসব বাপ-মায়ের আদিখ্যেতায় ইংরাজী-মিডিয়াম স্কুলে পড়তে যাওয়া আজকের প্রজন্মের কুশিক্ষিত — মানে ill-literate, অর্থাৎ badly literate — বাঙালী ছানাপোনারা, এমনকি নিজেদের আঠারো বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরও রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-গান্ধীজী-নেতাজীর মতো বাঙালীদের সম্পর্কে পাঁচটা বাক্য বলতে বললে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর, তাদের অর্ধশিক্ষিত আত্মঘাতী বাপ-মায়েরা ছবি দেখালেও চিনতে পারে না বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু, বিপিনচন্দ্র পাল, ঋষি অরবিন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাষ্টারদা সূর্য্য সেন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদদের মতো বাঙালী মনীষীদের। অশিক্ষা আর অজ্ঞতা এখন এমন স্তরে নেমেছে, সভ্যতা-ভদ্রতা আর শিক্ষা-সংস্কৃতি দুটোকেই বাঙালী নিজে হাতে মাটি খুঁড়ে কবর দিয়ে দিয়েছে। “তুমি”-কালচার তৈরী হয়ে গেছে, সবাই সবাইকে “তুমি” সম্বোধন করছে, “আপনি” শব্দটা বাঙালী ভুলে গেছে। চারটে লাইক আর শেয়ার পাওয়ার জন্য বাঙালী ঘরের বউরা-মেয়েরা আধা-ল্যাংটো হয়ে ইউটিউবে ভিডিও বানাচ্ছে। এক বাঙালী অভিনেত্রী সাংসদ ‘ক’-র সঙ্গে প্রেম করে, ‘খ’-কে বিয়ে করে, ‘গ’-এর বাচ্চার মা হচ্ছে; আবার, অন্য এক বাঙালী গোয়েন্দা-গিন্নী অভিনেত্রী স্টেজে দাঁড়িয়ে “আমি কিন্তু খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারি” বলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা” গাইছে, আর তাই শুনে ও দেখে কচি-বুড়ো-আধবুড়ো তাবৎ বাঙালী পুরুষ-মহিলা হাততালি দিয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছে — এই তো অবস্থা বাঙালীর শিক্ষা-দীক্ষার, জ্ঞান-গম্যির, সৌজন্য-শালীনতার। মোদ্দা কথা হলো, গোটা বাঙালী জাতির এখন শ্মশানযাত্রার কার্নিভাল চলছে; আর এই সীমাহীন ছ্যাবলামি আর বেহায়াপনা, এই ঢ্যামনামোর সার্কাসটা দেখতে আমার অত্যন্ত কুৎসিত লাগছে; নিজে একজন বাঙালী হিসেবে আমার লজ্জা হচ্ছে, দুঃখ হচ্ছে, রাগ হচ্ছে।
প্রশ্ন : নীলোৎপল রায়ের ব্যক্তিসত্ত্বার প্রেক্ষিতে আমার পরের প্রশ্ন। আপনি এগুলো কাউকে বলেন না, এবং আপনার সঙ্গে খুব কাছ থেকে মেলামেশার সুযোগ যারা নিয়মিত পান, এমনকি তাঁরাও সকলে আপনার সম্পর্কে এসব কথা জানেন না অথবা খেয়াল করেন না। যেমন, আপনি ফেসবুকে-হোয়াটস্যাপে বা টেক্সট-মেসেজে সবসময় বাংলা ভাষায় বাংলা হরফে লেখেন; আপনি কালি-কলমে লিখতে ভালোবাসেন এবং লেখেন; আপনি ধুতি পরতে ভালোবাসেন এবং সুযোগ পেলেই পরেন; আপনি স্নাতক হয়ে যেদিন কলেজ ছেড়েছেন, সেদিন থেকেই জিন্স পরাও ছেড়ে দিয়েছেন, এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার স্নাতকোত্তরের সহপাঠীরাও কেউ কোনোদিন আপনাকে জিন্স-পরিহিত দেখার সুযোগ পান নি, মানে বিগত ২৪/২৫ বছরে আপনাকে কেউ জিন্স পরতে দেখেন নি; আপনি ট্যাঁক-ঘড়ি বা পকেট-ওয়াচ ব্যবহার করতে ভালোবাসেন এবং সুযোগ পেলেই করেন; আপনার বাড়িতে লেখাপড়া করার ঘরটিতে যে দেওয়াল-ঘড়িটি আছে সেটি লণ্ডনের Victoria কোম্পানীর ১৭৯২ সালের, মানে ২৩২ বছরের পুরোনো একটি ভিনটেজ মডেলের রেপ্লিকা; আবার, আপনার শোওয়ার ঘরে যে দেওয়াল-ঘড়িটি আছে সেটি লণ্ডনের Jefferson & Smith কোম্পানীর ১৮৫১ সালের, মানে ১৭৩ বছরের পুরোনো একটি ভিনটেজ মডেলের রেপ্লিকা; আরো সাংঘাতিক, আপনি বাড়িতে পড়াশোনা করার সময় যে Pince-nez চশমাটি ব্যবহার করেন, সেটি বঙ্গভঙ্গেরও দু’বছর আগে, ১৯০৩ সালে, আমেরিকার Ketcham & Mac Dougall কোম্পানীর বানানো, ১০ ক্যারাটের সোনা দিয়ে তৈরী — সোনার জল নয়, এবং এটি কিন্তু রেপ্লিকা নয়, ১২১ বছরের পুরোনো আসল চশমাটিই; এছাড়া, যেকোনো অপরিচিত মানুষকে আপনি “আপনি” ছাড়া অন্য কোনো সম্বোধন করতেই পারেন না; আপনি আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুজনদের প্রণাম করতে ভালোবাসেন; মিউজিকের ক্ষেত্রে একদিকে Whitney Houston-এর পপ-ব্যালাড, অন্যদিকে গুলাম আলির উর্দু গজল, আবার এদিকে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাংলা ভাটিয়ালী ও গণসঙ্গীত, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা টপ্পা ও মজলিসী গান, অংশুমান রায়ের বাংলা লোকগীতি, আপনার সবথেকে প্রিয়। তো এই সমস্তকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে, একজন বাঙালী হিসেবে, লেখক-নিজেকে নয়, ব্যক্তি-নিজেকে আপনি ঠিক কোথায় রাখবেন? মানে, আপনি কি একজন আর্কেয়িক ও ওল্ড-ফ্যাশণ্ড, পুরোনো দিনের মানুষ?
নীলোৎপল রায় : (হেসে) আপনি আমার ওপরে বেশ ভালো হোমওয়ার্ক করেছেন। যাই হোক, দেখুন, এটা রুচির প্রতিফলন। আমার এইসব শখ-আহ্লাদ, পছন্দ-অপছন্দ, কিংবা আমার ব্যক্তিগত জীবনযাপনের কিছু দৈনন্দিন ব্যবহারিক অভ্যাস-অভিরুচি — যেগুলির কিছু দৃষ্টান্ত আপনি দিলেন এখুনি — সেগুলি থেকে একথা সহজেই বোধগম্য হয়। তবে হ্যাঁ, সকলের বোধগম্য হবে না, কেবলমাত্র যাদের দেখার চোখ ও বোঝার রুচি আছে, তাঁদের কাছে ছাড়া। আর, আমাকে যারা প্রকৃতই চেনেন, জানেন, এবং বোঝেন, তাঁরা ভালোভাবেই অবগত আছেন, যে আমি এলিটিস্ট, বরাবরই। নতুন প্রজন্মের কাছে সস্তার জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য, আমি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া ভিত্তিহীন-যুক্তিহীন-মূল্যহীন কথা লিখে ফেসবুকে দিনে এক ডজন করে পোস্ট করতে পারবো না; কিংবা নিজেকে ইণ্টেলেকচুয়াল হিসেবে দেখানোর জন্য, আমি আধা-ল্যাংটো হয়ে মদের গ্লাস হাতে নিয়ে নাচতে-নাচতে ফেসবুক-লাইভ করতে পারবো না। বার্ট্রাণ্ড রাসেলের মতো, নীরদ সি. চৌধুরীর মতো, কমলকুমার মজুমদারের মতো, অমিয়ভূষণ মজুমদারের মতো, আমারও রুচি এবং বিচারের মাপকাঠি খুব-খুব-খুবই উঁচু তারে বাঁধা। আভিজাত্য, বণেদীয়ানা, ধ্রুপদীয়ানা, আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান, মর্যাদাব্যঞ্জক, এবং অবশ্যই গর্ব করার মতো সম্পদ। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে, যে মানুষের গর্ব করার মতো পারিবারিক অতীত নেই, ইতিহাস নেই, ঐতিহ্য নেই, তাঁকে আমি ঘৃণা করি। কেননা, ঐ সাবেকী এলিটিজমের পাশাপাশি, আমি যে আভিজাত্যে বিশ্বাস করি, তা হলো সৃজনশীলতার আভিজাত্য; আমি যে বণেদীয়ানায় ভরসা রাখি, তা হলো প্রতিভার বণেদীয়ানা; আমি যে ধ্রুপদীয়ানায় আস্থাশীল, তা হলো শিল্পবোধের ধ্রুপদীয়ানা। আমি এই দৃঢ় প্রত্যয় আমার হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে লালন করি, যে শুধুমাত্র বংশকৌলীন্য থাকলেই এলিট হওয়া যায় না, এবং একজন অনভিজাত, ঐতিহ্যহীন, ও অজ্ঞাতকুলশীল মানুষও নিজের নিষ্ঠা, যোগ্যতা, আর অধ্যবসায় দিয়ে মেধাগতভাবে এলিট হয়ে উঠতে পারেন, স্ব-শিক্ষিত তথা স্ব-প্রতিষ্ঠ হয়ে; হ্যাঁ, আমি মেধার এলিটিজমের পক্ষে। এই কারণেই, অর্জুনের মতো কপিবুক-ছাত্র যারা পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়, তাঁদের আমার কম পছন্দ; বরং শিশু ধ্রুবর মতো, বালক নচিকেতার মতো, কিশোর একলব্যের মতো, যুবক কর্ণের মতো, এবং প্রৌঢ় যাজ্ঞ্যবল্কের মতো self-taught তথা self-made শিষ্যরা আমার হৃদয়ের অনেক বেশী কাছের।
প্রশ্ন : আপনার এই নতুন উপন্যাসটিকে আপনি বলছেন একটি সোশিও-পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। এর ভেতরে কী আছে যদি একটু বলেন!
নীলোৎপল রায় : প্রথমেই জানাই যে এখন বইটি প্রেসে রয়েছে, আগে সেটি তৈরী হয়ে আসুক। উপযুক্ত সময় এলে, আগামী দিনে আমি নিশ্চয়ই বইটির ভিতরে কী আছে সে সম্পর্কে আমার পাঠকদের কিছুটা আভাস দেবো। আপনাদের মাধ্যমেই দু’-চার কথা বলবো সে বিষয়ে, প্রকাশ হওয়ার আগেই বলবো। এই মুহূর্তে আমি আপনাদের শুধু দু’টি বিষয়ে সামান্য কিছুটা ধারণা দিতে পারি। এক, উপন্যাসটির ‘ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার’ বা ‘আখ্যান কাঠামো’, এবং দুই, এতে ব্যবহৃত ‘ডায়ালেক্ট’ বা ‘ভাষা’। প্রথমে, ভাষার, মানে দ্বিতীয়টির কথাই বলি। আমার এই উপন্যাসটির শিরদাঁড়া ওরফে অক্ষদণ্ড হলো খাঁটি বাংলা ভাষা, যার মধ্যে যে কেবলই মাত্র অভিজাত বণেদী ভদ্রলোকের ভাষা আছে তা কিন্তু নয়, সঙ্গে অবশ্যই আছে একেবারে প্রান্তিক মানুষের, মানে ছোটলোকের ভাষাও, আছে তাঁদের নিজস্ব লব্জ, বাগধারা, তথা খিস্তি-খেউড়ও; এবং সেই ‘ভাষা’ হলো প্রকৃত প্রস্তাবে সমকালীন সময়ের এক অকপট ও পক্ষপাতহীন সামাজিক-রাজনৈতিক দর্পণ। আমার গ্রন্থটি এমনই এক সোশিও-পলিটিক্যাল আয়না যা আপনাকে ও সকলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে, বর্তমান বাঙালী সমাজের আসল চেহারাটা একেবারে আনসেন্সর্ডভাবে দেখাবে, যা ভয়াবহ, এবং মর্মন্তুদ। যা আপনাকে বোঝাবে, যে আপনার চারপাশের সমকালীন সমাজ ও সভ্যতার নৈতিক অবক্ষয় সম্পর্কে, আপনার নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্বের বিপর্যয় সম্পর্কে, আপনার সম্প্রদায়ের মানুষের — মানে বাঙালী জাতির — শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টিচর্চার গুণগত মানের অধঃপতন সম্পর্কে, আপনি যদি নিস্পৃহ হন, সচেতন না হন, সংবেদনশীল না হন, তাহলে এই যন্ত্রণার শরিক হওয়ার যোগ্যতা আপনি অর্জন করতে পারেন নি, এবং এই যন্ত্রণা আপনি কোনোদিনই অনুভব করতে পারবেনও না। সুতরাং, সর্বাগ্রে আপনাকে এই কঠিন বাস্তব পরিস্থিতিটি উপলব্ধি করতে হবে, যে আপনার সমাজ, সভ্যতা, ভাষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, কৃষ্টি আজ চরম সঙ্কটে; এই অপ্রিয় অথচ জ্বলন্ত সত্যটি যথাযথভাবে ঠাহর করতে পারলে, তবেই আপনি এই গ্রন্থে ব্যবহৃত ভাষার প্রকৃত তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন। এবার প্রথমটির, মানে আখ্যান কাঠামোর কথা বলি। এই উপন্যাসে, প্রাচীনতম থেকে আধুনিকতম বাংলা গদ্যসাহিত্যের সবচেয়ে নিরীক্ষামূলক, সবচেয়ে বিতর্কিত, আর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ন্যারেটিভ ফর্মগুলিকে অত্যন্ত মৌলিকভাবে পুনর্নির্মাণ, প্রতিনির্মাণ ও বিনির্মাণ করা হয়েছে। আখ্যানটির গদ্য-কাঠামোর ভাষাসঞ্জাত ব্যঙ্গ এবং intertextual hints ওরফে আন্তর্পাঠ্য আভাসগুলি, সমকালীন বাঙালী সম্প্রদায়ের নৈতিক ও বৌদ্ধিক অধঃপতনের প্রতীক হিসেবে একটি প্রাকৃত বৈশিষ্ট্যরূপে এখানে প্রতীয়মান হয়েছে; এবং নিজেদের দৈনন্দিন সমাজ-জীবনে, তথাকথিত অভিজাত, রুচিশীল ও আলোকপ্রাপ্ত, মধ্যবিত্ত বাঙালী ভদ্রলোক শ্রেণীর আচার-আচরণে আর ভাষাপ্রয়োগে, লাগামহীন অশ্লীলতার নির্লজ্জ অভ্যাসকে, বিদ্রুপাত্মকভাবে প্রতিফলিত করেছে। এই গ্রন্থটিতে যে নানাবিধ রকমের ‘ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার’ ব্যবহার করা হয়েছে, তার মাধ্যমে প্রতীকীভাবে, একবিংশ শতাব্দীতে মেধাগতভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বাঙালী জাতির, তথা সৃজনশীলতার দিক থেকে ক্রমশঃই আরো আরো অবনমন ঘটতে থাকা বাঙালী সংস্কৃতির, ভাষাকে ও আচরণকে কটাক্ষ করা হয়েছে।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক চেতনার প্রেক্ষিতে যদি বলি, আপনি এতখানি তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন একজন মানুষ; অথচ, আপনি ভোট দেন না! কেন?
নীলোৎপল রায় : আপনার প্রশ্নের মধ্যেই এর উত্তর আছে। রাজনৈতিকভাবে একজন সচেতন মানুষ বলেই আমি ভোট দিই না। আজ অবধি আমার জীবনে আমি একবারই মাত্র ভোট দিয়েছি, ১৯৯৬ সালের ১৩-ই মে, দ্বাদশতম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে, যে বছর একই সঙ্গে হয়েছিলো একাদশতম লোকসভা নির্বাচনও। আসলে, আপনার মস্তিষ্কের যদি মুক্ত চিন্তা করার সামর্থ্য থাকে, তবে আপনি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রশ্ন করবেন। অপ্রিয় প্রশ্ন, অস্বস্তিকর প্রশ্ন। আর, নিজের মস্তিষ্ককে মুক্ত চিন্তা করার সামর্থ্য অর্জন করাতে হলে, মস্তিষ্ককে পুষ্টি জোগাতে হবে, যে পুষ্টি হলো বই। সিলেবাসের বই নয়, সিলেবাসের বাইরের বই। আমাদের দেশের অতি-উচ্চশিক্ষিত সমস্ত মাননীয় ও মাননীয়া মন্ত্রীমশাইদের, আই.এ.এস. আমলাদের, আই.পি.এস. পুলিশ আধিকারিকদের, আদালতের আইনজীবীদের, বিচারকদের, ডাক্তারবাবুদের, সংবাদপত্র সম্পাদকদের, সাংবাদিকদের, অধ্যাপকদের ও মাষ্টারমশাইদের ডেকে একটু জিজ্ঞাসা করে দেখুন তো, যে এঁদের মধ্যে ক’জন বলতে পারেন — “Patriotism is the last refuge of the scoundrel.” — এই কথাটা কে বলেছিলেন? অথবা, “it is better to be a human being dissatisfied than a pig satisfied.” — এটা কার উক্তি? কিংবা, “Democracy is the menopause of Western society, the Grand Climacteric of the body social.” — কার বক্তব্য? তাঁরা আদৌ বোঝেন এই কথাগুলির মর্মার্থ কী? তাঁরা কখনো ভেবেছেন এসব নিয়ে? নিজেদেরকে মহাশিক্ষিত মনে করা মন্ত্রী, আই.এ.এস., আই.পি.এস., অ্যাডভোকেট, জাজ, ডাক্তার, এডিটর, জার্নালিস্ট, প্রফেসর বা শিক্ষকরা ক’জন পড়েছেন — স্যামুয়েল জনসনের লেখা ‘The Patriot’, কিংবা জন স্টুয়ার্ট মিলের লেখা ‘Utilitarianism’, অথবা জাঁ বদ্রিলারের লেখা ‘Cool Memories : 1980-1985’? আসলে, এঁদের সমস্যাটা কোথায় জানেন? এনারা অনেক প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করে, যথাযথভাবে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে, যে যার পদে যান ঠিকই; কিন্তু, প্রথমতঃ, পদে বসার পর থেকে এঁরা নিজেদের সর্বজ্ঞ বোদ্ধা ভাবতে আরম্ভ করেন ও পড়াশোনা করা বন্ধ করে দেন, এবং দ্বিতীয়তঃ, এঁদের অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনাটা অত্যন্ত মাঝারি মানের হওয়ায়, কিংবা একেবারেই শূন্য হওয়ায়, দূরদর্শী, বৈপ্লবিক, কিংবা যুগান্তকারী কিছু ভেবে ওঠা, বলে ওঠা, বা করে ওঠা এঁদের মগজে কুলোয় না। এঁরা কেবল দম দেওয়া কলের পুতুলের মতো, একটা মান্ধাতার আমলের পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকা পঙ্গু সিস্টেমকে অন্ধ আনুগত্য নিয়ে অনুসরণ করে চলেন, নিজেদের গোটা জীবনটা ধরে। সিস্টেমকে প্রশ্ন করার মতো সততা কিংবা শিরদাঁড়া থাকা তো দূরের কথা, সেই মুক্ত চিন্তার সামর্থ্যই এঁদের মগজের থাকে না। যে রাষ্ট্রীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় দেশের মানুষের সাংবিধানিক স্বাধীনতা খর্ব হয়, রাজনৈতিক অধিকার লুণ্ঠিত হয়, গণতান্ত্রিক পরিসর বিপন্ন হয়, সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, নাগরিক জীবন সঙ্কটগ্রস্ত হয়, ব্যক্তিসত্ত্বার অবমাননা হয়, এবং সর্বোপরি, সংসদীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, সেই ব্যবস্থা নির্বাচনের নামে প্রহসন মাত্র। নির্বাচন পরিচালনা করতে হলে সবার আগে রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে, যে সারা দেশের কোনো প্রান্তে, কোথাও, একটিও গুলি চলবে না, একটিও বোমা ফাটবে না, একটিও প্রাণহানি হবে না। আর, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যদি একজন মানুষেরও মৃত্যু ঘটে, তবে তৎক্ষণাৎ তার নৈতিক দায় স্বীকার করে নিয়ে, দেশের রাষ্ট্রপতিকে ও প্রধানমন্ত্রীকে, এবং যে রাজ্যে ঐ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে হবে। আগে সারা দেশে নির্বাচনের উপযুক্ত আদর্শ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরী করতে হবে, নাগরিকদের প্রকৃত অর্থে সভ্য ও পরিণতমনস্ক করে তুলতে হবে, মানুষের মনে সত্যিকারের নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা ও মানবিক সচেতনতা সঞ্চারিত করতে হবে, তারপর তো আসবে নির্বাচনের প্রশ্ন।
প্রশ্ন : এই মুহূর্তে কী কী বই পড়ছেন?
নীলোৎপল রায় : প্রথমেই মনে আসছে একটি অসাধারণ বই, দ্য মার্গ ফাউণ্ডেশন প্রকাশিত ‘Lessons from Hell : Printing and Punishment in India’ যেটি সম্পাদনা করেছেন ক্রিস্টোফার পিনি; হীরেন ভট্টাচার্যর একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বই ‘সংস্কৃতি ভোগবাদ ও মূল্যবোধ’; আর রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর ‘বাঙালীর নতুন আত্মপরিচয়’, আপাততঃ এই তিনটি বই পড়ছি। তাছাড়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি দু’টি এখনো প্রকাশিত না হওয়া বইয়ের জন্য। একটি প্রকাশিত হবে এই বছরের ১০-ই ডিসেম্বর, প্রকাশক হেমার্কেট বুকস, বইটির নাম ‘A Livable Future is Possible : Confronting the Threats to Our Survival’ যেটি হলো রাজনৈতিক-অর্থনীতিবিদ সি. জে. পলিক্রোনিয়াও-র নেওয়া নোয়াম চমস্কি-র বেশ কিছু নতুন সাক্ষাৎকারের সংকলন। আপনি নিশ্চয়ই জানবেন যে চমস্কির বয়স এখন ৯৫ বছর, যিনি এই মুহূর্তে সম্ভবতঃ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীবিত থিংকার, এই বয়সেও কী অভাবনীয় ক্ষুরধার মস্তিষ্ক! আর একটি বই এই বছরই প্রকাশিত হতে চলেছে নীরদ সি চৌধুরীর ২৫-তম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে, তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু আলাস্টেয়ার নিভেন-এর লেখা ‘Knowing the Unknown : Nirad C Chaudhuri’ শিরোনামে, যেটির প্রকাশক হলো পিপ্পা রান বুকস।
প্রশ্ন : আপনার সঙ্গে কথা বলে অনেক ঋদ্ধ হলাম। আপনার পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনি কোনো বিশেষ বার্তা দিতে চান?
নীলোৎপল রায় : অবশ্যই। তবে, এটি ঠিক আমার পাঠকদের উদ্দেশ্যে বার্তা নয়; বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষ আবেদন, আপনাদের কমিউনিটির কাছে; মানে, বিভিন্ন প্রিণ্ট, ইলেকট্রনিক ও অডিও-ভিস্যুয়াল সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক কর্মীবন্ধুদের উদ্দেশ্যে। জীবনানন্দ তাঁর ‘এই সব দিনরাত্রি’ কবিতায় লিখেছিলেন :
“মনে পড়ে কবে এক রাত্রির স্বপ্নের ভিতরে
শুনেছি একটি কুষ্ঠকলঙ্কিত নারী
কেমন আশ্চর্য গান গায়;
বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়;”
আপনারা দয়া করে অর্ধশিক্ষিত ও মূর্খ সেলিব্রিটিদের ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাঙালী জাতির আইকন হিসেবে প্রচার করা বন্ধ করুন। চোখ-কান খোলা রেখে একটু সৎভাবে খুঁজুন। দেখবেন আমার-আপনার আশেপাশে এমন অনেক কুষ্ঠকলঙ্কিত নারী আছেন যারা আশ্চর্য গান গাইছেন, এমন অনেক বোবা কালা পাগল মিনসে আছেন যারা অপরূপ বেহালা বাজাচ্ছেন, তাঁদের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরুন। তাঁরাই বাঙালী জাতির প্রকৃত আইকন। তাঁদের কথা মানুষের জানা দরকার।