বিক্রম ব্যানার্জী, কলকাতা: নানান গোঁড়ামির বাঁধন ছাড়িয়ে নারীরা আজ স্বাধীন। তাঁরা স্বয়ংসম্পূর্ণা। তবে 1960-70 এর দশকে চিত্রটা একেবারেই এমন ছিল না। সাদাকালোর দুনিয়ায় নানা কালা কানুন, কুসংস্কারের মধ্যে দিয়ে দিন গুজরান করতে হয়েছে মেয়েদের। একটা সময় ছিল যখন, স্বামীর সাথেই একই চিতায় উঠতে হতো বিধবা স্ত্রীকেও। তবে সময়ের সাথে সাথে সবটাই মলিন হয়ে গিয়েছে। শিক্ষার প্রখর আলোয় ঘুঁচেছে সব অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কার।
তবে বদলের হাল ধরেছিল কিন্তু মেয়েরাই। বারবার নারীরাই এগিয়ে এসে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তেমনই এক নারীর কাহিনী আজ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে। দেশের প্রথম মহিলা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (India’s First Woman Civil Engineer) শকুন্তলা ভগতের নামটা অনেকে না শুনে থাকলেও তাঁর দেখানো পথে হেঁটে সেতু তৈরির কাজটা অনেকটাই সহজ হয়েছে নতুন প্রজন্মের ইঞ্জিনিয়ারদের পক্ষে। জানলে অবাক হতে হয়, এই মহিলার হাত ধরেই গোটা বিশ্ব জুড়ে তৈরি হয়েছে 200টি সেতু।
শকুন্তলার প্রথম মহিলা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠার গল্প
সালটা 1953। সে বছরই ভেরমাটা জিজাবাই টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক হন দেশের এই কৃতি নারী। সেই বছরটাই তাঁকে দেশের প্রথম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছিল। প্রথম পর্বে, একটি কারখানায় ইন্টার্ন বা শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজে ঢুকেছিলেন শকুন্তলা। দায়িত্ব হিসেবে পেয়েছিলেন বেশ কিছু কঠিন কাজ। তেমনই একদিন নিজের কর্ম দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনসাইড বিস্ফোরণের শিকার হন শকুন্তলা। তাতে বেশ আঘাতও পেয়েছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে দীর্ঘ চিকিৎসার পর মেয়ের মনোবল বাড়াতে ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য মেয়েকে জার্মানি পাঠান বাবা। পরবর্তীতে দু বছরের চাকরির মেয়াদ শেষ করে দেশে ফিরেছিলেন শকুন্তলা। সালটা ছিল 1959। সে বছর থেকে 1970 সাল পর্যন্ত আইআইটি বোম্বেতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহকারি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন তিনি। বলে রাখি, ভারতের প্রথম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করার জন্য দু বছরের স্যবব্যাটিকাল গ্রহণ করেছিলেন। এরপরই একেবারে মাঠে নেমে পড়া।
শকুন্তলা বিশ্বাস করতেন যে ইঞ্জিনিয়ারিং মানুষের মুখোমুখি হওয়া বাস্তব ও জরুরী সমস্যার সমাধান করে। সেই ভাবনা থেকেই 1970 সালে স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজস্ব ব্রিজ বিল্ডিং ফার্ম, কোয়াড্রিকন প্রতিষ্ঠা করেন শকুন্তলা। এর মধ্যে দিয়ে কম খরচে প্রাক ফেবরিকেটেড মডিউলার অংশের বিভিন্ন স্ট্যান্ড এবং প্রস্থের সেতু তৈরি করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সাল 1972। সে বছর ভারতে ইঞ্জিনিয়ারিং এমন কিছু দেখলো যা আগে কখনও দেখা যায়নি। শকুন্তলার প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে তৈরি হয়েছিল ইন্টারলোকিং সিস্টেম। শুধু তাই নয়, শকুন্তলার হাত ধরে ওই সংস্থায় শেখায় কীভাবে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে সেতু তৈরি করা যায়। তৈরি হয় সেতুর নকশা। বলে রাখি, বিশেষ উদ্ভাবনের জন্য শকুন্তলা সুফ্যাংকে ইনভেনশন প্রমোশন বোর্ড থেকে সর্বোচ্চ সম্মান অর্জন করেন। পরবর্তীতে এই উদ্ভাবনই সেতু নির্মাণে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল।
1972 সালে প্রথমবারের জন্য শকুন্তলা এবং তার স্বামীর প্রতিষ্ঠান কোয়াড্রিকনের কাছে বড় পরীক্ষা আসে। হিমাচলপ্রদেশের একটি ব্রিজ তৈরির দায়িত্ব পড়ে তাদের হাতে। উল্লেখযোগ্য বিষয়, সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মাত্র চার মাসের মধ্যে হিমাচলের স্পিতিতে দুটি মডুলার ব্রিজ তৈরি করে ফেলেন এই দম্পতি। সবচেয়ে বড় কথা, ভারী যন্ত্রপাতি ছাড়াই সেই ব্রিজ বা সেতু তৈরি করেছিলেন তাঁরা। প্রথম সাফল্যের কথা পাঁচ কান হতেই একের পর এক অর্ডার আসতে থাকে শকুন্তলাদের কাছে। এরপর থেকে 1978 সালের মধ্যে পেটেন্ট সিস্টেমটি কাশ্মীর থেকে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত ভারতজুড়ে 69টি সেতু নির্মাণে সাহায্য করেছিল। তবে শুধু ভারত নয়, যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন, আমেরিকা এমনকি জার্মানি মিলিয়ে গোটা বিশ্বে মোট 200টি সেতু তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন দেশের প্রথম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শকুন্তলা ভগত।
অবশ্যই পড়ুন: ১ লাখকে বানিয়েছে ৮১ লক্ষ, বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে ২২৫ টাকার এই স্টক
প্রসঙ্গত, সেতু তৈরির উদ্ভাবনী নকশার জন্য 1993 সালে শকুন্তলাকে ওম্যান অফ দ্য ইয়ার পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। পরবর্তীতে সেই নারীই 2012 সালে 79 বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। তবে কথায় আছে, শিল্পীর মৃত্যু হয় না। ভারতের সেতু তৈরির ইতিহাস যত আলোচিত হবে, ততবারই দেশের প্রথম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শকুন্তলা ভগতের প্রসঙ্গ উঠবে। চলবে জোর আলোচনা। আর এসবের মধ্যে দিয়েই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ভগত।