India Hood Decode: কীভাবে ভারতকে ব্ল্যাকম্যাল করলো Indigo? জানলে রেগে উঠবেন আপনিও

Indigo Crisis
Indigo Crisis

যে যুগে ভারতের বেশ কিছু রেলস্টেশন হয়ে উঠছে এয়ারপোর্টের মতো উন্নত ও অ্যাডভান্স, সে যুগেই টানা ৪ দিন এয়ারপোর্ট হয়ে উঠল রেল স্টেশনের মতন জঘন্য। কোথাও দেখা গেল এয়ারপোর্টের মেঝেতেই শয়ে শয়ে ঘুমাচ্ছে লোক, কোথাও আবার লম্বা লাইন পড়েছে কিয়সকে, তো কেউ মেঝেতে বসেই খেলছে তাস। আবার বেশ কিছু প্যাসেঞ্জার ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে স্টাফদের ওপর। এই দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছে সারা দেশ।

একদমই ঠিক ধরেছেন, আমরা কথা বলছি ইন্ডিগো (Indigo) বিমান সংকট নিয়ে। যেখানে ডিসেম্বরের শুরুতেই বাতিল হয়েছে প্রায় ২০০০ ইন্ডিগো ফ্লাইট। তবে অন্যরাও ধোয়া তুলসি পাতা নয়। কারণ এই সুযোগের সুবিধা লুটেছে এয়ার ইন্ডিয়া, স্পাইসজেট, আকাসার মতো সংস্থারা, যারা টিকিটের দাম বাড়িয়েছে ৩ থেকে ৪ গুণ। গত কয়েকদিনে হয়রানির শিকার হয়েছেন কয়েক হাজার যাত্রী। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি –  যেভাবে আতঙ্কবাদীরা দেশের সাধারণ মানুষকে বন্দুকের নাগালে রেখে সরকারকে ব্ল্যাকমেল করে, তেমনই এবার দেখা গেল দেশের সাধারন মানুষকে হয়রানি করিয়ে সরকারকে ব্ল্যাকমেল করল ইন্ডিগো।

কিন্তু, এই দায় শুধুই কি একা ইন্ডিগো-র? নাকি দায় পড়ে সরকারের ওপরেও? অভিযোগ – এই পুরো বিষয়টি নাকি ইন্ডিগো-র মস্তিষ্কপ্রসূত – আদৌ কি তা সত্যি? সরকার কি বাগে আনতে পারবে ইন্ডিগো-কে? এর পিছনে কি রয়েছে মনোপলি, নাকি অন্য কোনও কারণ?

আজ India Hood ডিকোড-এ আমরা তুলে ধরবো সমস্ত তথ্য, সমস্ত সত্য – যা এই বিষয়টিকে জলের মতো পরিস্কার করে দেবে আপনার কাছে। তাই ধৈর্য ধরে দেখতে থাকুন শেষ পর্যন্ত। আপনি আমাদের চ্যানেলে নতুন হয়ে থাকলে অবশ্যই সাবস্ক্রাইব করুন।

আদৌ কি ডিসেম্বর থেকে শুরু এই বিপর্যয়?

অনেকেই মনে করেন এই ঘটনার সূত্রপাত ২০২৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর থেকে। যখন হঠাৎ করেই সারা দেশজুড়ে বাতিল হয় ইন্ডিগো-র ২০০টিরও বেশি ফ্লাইট। আর ভোগান্তিতে পড়ে প্রায় কয়েক হাজার যাত্রী। অনেকেই এটিকে সাধারণ বিপর্যয় হিসাবে ধরে নেয়। কিন্তু সংকট বাড়ে, যখন পরপর ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ তারিখেও বাতিল হতে থাকে ইন্ডিগো-র আরও ২৯০০-র বেশি ফ্লাইট। তখনই উঠে আসে একের পর এক তথ্য। তারপর শুরু হয় ক্ষোভ, বিশ্লেষণ, আর দায় চাপানো একে অপরের ওপর।

এর পরেই ইন্ডিগো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নেয় যাত্রীদের কাছে। তবে তারা তাদের পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার জন্য দায় করে টেকনিক্যাল ইস্যু, শীতকালীন সময়সূচি পরিবর্তন, প্রতিকূল আবহাওয়া, যানজট এবং DGCA-র সংশোধিত সময়সূচিকে।

জানলে অবাক হবেন, চলতি বছরের গোটা নভেম্বর মাসেও ইন্ডিগো বাতিল করেছে প্রায় ১২৩২টি ফ্লাইট।

কিন্তু ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০২৪ সালে…

কিন্তু, এই ঘটনার আসল সূত্রপাত হয় ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে। যখন ফ্লাইট যাত্রাকে আরও নিরাপদ এবং সুরক্ষিত করার জন্য DGCA সারা দেশের সমস্ত এয়ারলাইন সেক্টরের ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশন অর্থাৎ FDTL নিয়মকে পুনর্বিবেচনা করে। এবং চলতি নিয়মে বেশ কিছু সংশোধন করে।

যে নিয়মগুলি সংশোধন করা হয়, তার মধ্যে –

প্রথমেই ছিল – প্রতিটি পাইলটকে সপ্তাহে ২ দিন অর্থাৎ ৪৮ ঘণ্টার ছুটি দিতেই হবে। আগে যা ছিল দেড় দিন অর্থাৎ ৩৬ ঘণ্টা।

দ্বিতীয় ছিল নাইট ডিউটি টাইম ১২টা থেকে ৫টার পরিবর্তে ১২টা থেকে ৬টা পর্যন্ত করা। অর্থাৎ, ধরুন আগে কেউ সকাল ৫টার পরিবর্তে ৫টা ৫-এ ডিউটি শুরু করলে তা ডে ডিউটি টাইম হিসাবে ধরা হতো। কিন্তু নতুন নিয়মে এটি নাইট ডিউটি টাইম হিসাবে ধরা হবে।

তৃতীয় ছিল – প্রতি সপ্তাহে মাত্র ২টি বিমান রাতে ল্যান্ড করাতে পারবেন পাইলট। আগে এই সংখ্যাটা ছিল ৬। অর্থাৎ, নাইট ল্যান্ডিং ৬ থেকে কমিয়ে ২ করে দেওয়া হয়।

চতুর্থ ছিল – সমস্ত পাইলট এবং বিমানকর্মীদের পরপর দুদিন নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে সপ্তাহে এক বার করে।

আর পঞ্চমত ছিল – পাইলট এবং বিমানকর্মীদের ছুটিকে সাপ্তাহিক বিশ্রামের মধ্যে ধরা যাবে না।

নতুন আরও নিয়ম অনুযায়ী, একজন বিমানকর্মী দিনে আট ঘণ্টা, সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টা, মাসে ১২৫ ঘণ্টা এবং বছরে সর্বোচ্চ ১,০০০ ঘণ্টা কাজ করবেন। সঙ্গে বিশ্রামের জন্যও বাধ্যতামূলক ভাবে নির্দিষ্ট সময় রাখতে হবে। দিনে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ থাকবে, যাতে পাইলট এবং কেবিন ক্রুরা সকলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম পান। এতে কাজের সময় পাইলটদের ক্লান্তি কিংবা অসাবধানতার ফলে বড়সড় বিপদ ঘটার ঝুঁকি কমবে। আর ভারত সরকারকে সমস্ত এয়ারলাইন সংস্থার রুস্টার অর্থাৎ শিডিউল লিস্ট জমা দিতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে।

চলতি বছরে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনার পর থেকে যেভাবে পাইলটদের ওপর আঙুল তোলা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, সেই দিক থেকে এই নিয়ম যে পাইলট এবং যাত্রী উভয়ের জন্যই বেশ লাভজনক ছিল তা বলাই বাহুল্য।

তাহলে সমস্যার শুরু কোথা থেকে হয়?

তবে এভিয়েশন কোম্পানিগুলি সরকারকে জানিয়ে দেয় – এই নিয়ম লাগু করতে সময় লাগবে, তাই সময়সীমা যেন বাড়ানো হয়। ফলত সরকারের সাথে মতবিরোধ বাড়ে, মামলা গড়ায় হাইকোর্টেও। হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, একবারে না হলেও যেন দুটি পর্যায়ে এই কাজ করা হয়। কিন্তু করতে হবেই।

যার মধ্যে প্রথম পর্যায়টি ২০২৫ সালের ১লা জুলাই থেকে এফডিটিএলের ২২টি নির্দেশিকা চালু হয়। বাকি সাতটি ১লা নভেম্বর থেকে চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

আর তারপর থেকেই শুরু হয় সমস্যা। অন্যান্য সমস্ত এয়ারলাইন সংস্থার ক্ষেত্রে সমস্যা না হলেও। সমস্যা দেখা দেয় ইন্ডিগোর ক্ষেত্রে। অক্টোবর মাসে যেখানে ইন্ডিগোর অন টাইম পারফরম্যান্স ছিল ৮৪ শতাংশের বেশি, তা নভেম্বরে নেমে আসে ৬৮ শতাংশের নীচে। ইন্ডিগো জানায়, গোটা নভেম্বর মাসে তারা একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েও খুব কম উড়ান বাতিল করেছে। কিন্তু ডিসেম্বরে ইন্ডিগোর অন টাইম পারফরম্যান্স ৫০-এ নেমে আসে, এরপর সেখানে থেকে বর্তমানে ৮ শতাংশে।

পরিস্থিতি এতটাই বিগড়ে যায় যে ক্ষমা চাইতে হয় সরকারকেও!

আর তার পরেই শুরু হয় একের পর এক সমস্যা। দেখা যায়, ফ্লাইট বাতিল। যাত্রী বিপর্যয় সহ আরও অনেক সমস্যা। এরপর ৫ই ডিসেম্বর সংস্থার তরফ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া হলেও থামে না বিপর্যয়। চলতে থাকে সমস্যা, আর ফ্লাইট বাতিলের ধারা। সবশেষে DGCA পিছু হটে এবং সমস্ত নিয়ম ২০২৬ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিলম্বিত করে দেয়। আর একটি নিয়ম শিথিল করা হয়, যেখানে বলা হয়েছিল, পাইলটদের নেওয়া ছুটিকে সাপ্তাহিক বিশ্রামের যে নির্দিষ্ট সময়সীমা, তাতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। অর্থাৎ, পাইলটরা আগাম ছুটি নিন বা না-নিন, সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বিশ্রাম দিতেই হবে তাঁদের।

আর ইন্ডিগোর এই ব্যবস্থাপনার গাফিলতির জন্য তদন্ত শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়। গঠন করা হয় চার সদস্যের একটি কমিটি। পাশাপাশি ইন্ডিগো বিপর্যয়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেন কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী কে রামমোহন নায়ডু। একইসঙ্গে কঠোর এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। শুধু ইন্ডিগো নয়, দেশের উড়ান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ-কেও তদন্তের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, “ইন্ডিগো বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে কী ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে ডিজিসিএ, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে।“ শোকজ করা হয় ইন্ডিগো কর্তৃপক্ষকেও। ইন্ডিগো-র তরফ থেকে এই শোকজের জবাব দেওয়া হলেও তা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়নি কেন্দ্রীয় সরকার।

এরপর যাত্রীদের ৮২৭ কোটি টাকা ফেরানো হয় ইন্ডিগোর তরফ থেকে।

আসল দায় কার?

এরপর এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশন অর্থাৎ ALPA-র তরফ থেকে এই সমস্ত ঘটনার জন্য দায় করা হয় ইন্ডিগোকেই। তারা জানায়, ইন্ডিগো এই নিয়মগুলি লাগু করতেই চায় না। তাদের নিয়মই কম কর্মী, বেশি কাজ। তাই দুই বছর আগে নিয়ম লাগু হলেও, ইন্ডিগো ক্রু নিয়োগ বাড়ানোর পরিবর্তে, নিয়োগ ফ্রিজ করে দেয়। পাইলট ইউনিয়নের বক্তব্য ছিল – এই পরিস্থিতি বেড়েছে ইন্ডিগোর জন্যই। তারা চায়নি নতুন নিয়ম লাগু হোক, অতিরিক্ত ক্রু-এর খরচা দিতে হোক।

তবে, সরকার ইন্ডিগো-র জন্য নিয়ম শিথিল করতেই, সরকারের পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ALPA।

অন্যদিকে, কংগ্রেস ও তৃণমূলের তরফ থেকে এই ঘটনার জন্য দায় করা হয় কেন্দ্রীয় সরকারকেই।

আদৌ কি ইচ্ছে করে এই কাজ করেছে ইন্ডিগো?

ভারতের পার্লামেন্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, Indigo-তে পাইলট সংখ্যা চলতি বছরে ৫৪৬৩ থেকে ৫০৮৫-তে নেমে আসে। যা মোট সংখ্যার ৭ শতাংশ। সেই কারণে ৭ শতাংশ ফ্লাইট বাতিল হওয়া উচিত, অর্থাৎ ১৪০ থেকে ২১০ টি। কিন্তু হয়েছে ১০০০-এরও বেশি। সেটা কীভাবে সম্ভব?

 সরকারের পদক্ষেপ!

তবে, সরকার যে ইন্ডিগো-কে এই ব্ল্যাকমেলের জন্য রেয়াত করবে না তারও ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী রামমোহন নায়ডুর কাজে। তিনি রাজ্যসভায় জানিয়েছেন, – এমন পদক্ষেপ নেবেন ইন্ডিগো-র বিরুদ্ধে, যাতে তা উদাহরণ তৈরি করে একটা। ইতিমধ্যেই এই সংস্থার কাছ থেকে তাদের ১০ শতাংশ রুট নিয়ে নেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সেই সমস্ত রুট, যেগুলিতে তারা পয়সা বানায়।

যার পরেই নড়েচড়ে বসে সমস্ত এয়ারলাইন সংস্থা। তড়িঘড়ি প্রায় ১৪ হাজার পাইলট নিয়োগ করেছে ছ’টি বিমানসংস্থা।

তবে, এখন মেটেনি তদন্ত, শেষ হয়নি সমস্যাও। এর শেষ কীভাবে হবে জানা নেই আমাদের, তবে এই ঘটনা একটি শিক্ষা দিয়ে গেল আমাদের। তা হল মনোপলির প্রভাব!

তাহলে মনোপলিই কী আসল সমস্যা?

দেখুন, IndiGo ভারতের এয়ারলাইন ব্যবস্থার ৬৫ শতাংশ বাজার একাই নিয়ন্ত্রণ করে। আর তাই তারা দু’বছর সময় পেয়েও নিয়ম লাগু না করে, দেশের মানুষকে হয়রানি করে সরকারকে ব্ল্যাকমেল শুরু করে।

অন্যদিকে, আমাদের টেলিকম সংস্থায় আগে যেখানে এয়ারসেল, ইউনিনর, আইডিয়া, ভোডাফোন, এয়ারটেল, রিলায়েন্স ছিল – সেখানে এখন একছত্র রাজ জিও এবং এয়ারটেল-এর। আগে আমাদের কাছে অপশন থাকতো কম বেশি প্ল্যান বেছে নেওয়ার। কিন্তু, এখন যেহেতু মার্কেটে প্লেয়ারই দুটো, তাই অপশনও খুবই কম। তাদের দামই আমাদের মেনে নিতে হয়।

তেমনি, সিমেন্ট ব্যবসাতেও একছত্র রাজ আদানি এবং JSW-র।

এই মনোপলি বা ডুয়োপলি – প্রকৃতপক্ষে ভারতবাসীর জন্য যে চিন্তার বিষয় তা কিন্তু স্পষ্ট। ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত – কেবল একটি কোম্পানির জন্য ভবিষ্যতেও ভুগতে হতে পারে ভারতবাসীকে।

এই গোটা ঘটনার জন্য আপনি কাকে দায়ী মনে করছেন?

Leave a Comment