India Hood Decode: কীভাবে মাওবাদীদের খেলা শেষ করলেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ?

Maoism
Maoism

কখনও ভারতীয় সেনাদের হত্যা, আবার কখনও দেশের নেতা-মন্ত্রীদের হত্যা, আবার কখনও নিরীহ সাধারণ মানুষদের হত্যা – নিজেদের ইচ্ছা পূরণের জন্য বছরের পর বছর ধরে ভারতে তাণ্ডব চালিয়ে আসছে মাওবাদীরা (Maoism)।
কংগ্রেস হোক বা বিজেপি, ইন্দিরা গান্ধী হোক বা অটল বিহারী বাজপেয়ী – কেউই সম্পূর্ণরূপে খতম করতে পারেনি মাওবাদকে।

কিন্তু, ভারতে মোদী সরকার আসতেই দেখা গেল এক অন্য রূপ। ঘোষণা হল ভারত থেকে মাওবাদ শেষ করার ডেডলাইন। শুরু হল – কখনও হাতে তো কখনও ভাতে মারার প্ল্যানিং। আর তারপর থেকেই তিলে তিলে খতম হতে থাকে মাওবাদ। লেগে যায় মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের হিড়িক।

ঠিক কী এমন করল মোদী সরকার, যার ফলে পুরো খেলাটাই পাল্টে গেল মাওবাদীদের? কেন একে একে সবাই লাইন লাগাচ্ছে আত্মসমর্পণের জন্য? কীভাবে এই অসম্ভভকে সম্ভব করলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ?

আজ India Hood ডিকোডে আমরা তুলে ধরবো এমন কিছু তথ্য, এমন কিছু সত্য যা জানলে পাল্টে যাবে মাওবাদ সম্পর্কে আপনার সম্পূর্ণ ধারণা।

মার্ক্সবাদ কী? | What Is Maoism?

নকশালবাদ বা মাওবাদ – এই শব্দগুলোর সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। কিন্তু, যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কেন এদের এই নামে ডাকা হয়, কারা এরা – অধিকাংশই দিতে পারবে না এর সঠিক উত্তর। আসলে নকশালবাদ বা মাওবাদ – এর উৎপত্তি মার্ক্সবাদ থেকে। তাই প্রথমেই আমাদের জানতে হবে মার্ক্সবাদ কী?

১৮ এবং ১৯-এর দশক, সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটছে শিল্পবিপ্লব। কিন্তু, শিল্পখাতে কোনও নীতিমালা ও ফ্রেমওয়ার্ক না থাকায় শ্রমিকদের করা হত শোষণ। যার ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় দুটি শ্রেণীর – মালিক আর শ্রমিক। আর সেইসময়ে সমাজের এই বিভেদ সম্পর্কে একটি ডকুমেন্ট লেখেন জার্মান দার্শনিক এবং অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্স। নাম দেন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। যা প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। আর এখানে থেকেই জন্ম হয় কমিউনিউজিমের।

এই ডকুমেন্টে তিনি বলেন এমন এক সমাজের কথা, যেখানে কোনও শ্রেণি থাকবে না, থাকবে না পুঁজিপতি। সবাই হবে সমান। সাথে তিনি বলেন, মালিক গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, অর্থ নিজে থেকে দেবে না। তাই শ্রমিকদের এই বিভেদ মেটানোর জন্য দরকার পড়লে বেছে নিতে হবে হিংসার রাস্তা। আর কার্ল মার্ক্সের তৈরি এই ভাবধারাকেই বলা হয় মার্ক্সবাদ

যার পর থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেখা যায় পরিবর্তন। হতে থাকে ছোট-খাটো বিভিন্ন বিক্ষোভ। তবে, ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এই সবই ছিল নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু, ওই বছরই রাশিয়ায় বিক্ষোভ ছাড়িয়ে যায় নিয়ন্ত্রণের মাত্রা। কমিউনিজমকে ভিত্তি করে, ভ্লাদিমির লেনিন নামের একজন ব্যাক্তি, শ্রমিক এবং কৃষকদের নিয়ে রাজার বিরুদ্ধে শুরু করেন বিদ্রোহ। অবশেষে রাজা নত হয়। আর কমিউনিজমকে ভিত্তি করে সারা বিশ্বের মধ্যে রাশিয়ায় প্রথম গঠিত হয় কমিউনিস্ট সরকার। আর রাশিয়ার নতুন নাম হয় USSR অর্থাৎ Union of Soviet Socialist Republics

এবার জানাবো ভারতে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করল মার্ক্সবাদ বা কমিউনিজম?

জানলে অবাক হবেন, এক বাঙালির নেতৃত্বেই ভারতে শুরু হয়েছিল মার্ক্সবাদ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ধীরে ধীরে কার্ল মার্ক্সের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, ঠিক তখনই ভারতের একজন বাঙালি থিঙ্কার এম এন রায় এই ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হন, ফ্যান হয়ে ওঠেন রাশিয়ায় লেনিনের বিপ্লবের। তিনি কয়েকজনকে নিয়ে যাত্রা করেন USSR-এ। আর ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর সেখান থেকেই লঞ্চ করেন কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া অর্থাৎ CPI

পরবর্তীকালে, তাদের মধ্যে কয়েকজন ফিরে আসেন এবং ভারতের মধ্যে এই ভাবধারা ছড়িয়ে দিতে থাকে। আর ১৯২৫ সালের ২৬শে ডিসেম্বর, ভারতের উত্তরপ্রদেশের কানপুরে অনুষ্ঠিত হওয়া কানপুর কনফারেন্সে, ভারতের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু করা হয় কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া

এদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে জমিদারি প্রথার অবসান ঘটানো, এবং সমাজের শ্রেণিভাগ মেটানো। তবে, জমিদারদের আগেই এদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় ব্রিটিশরা। এই পার্টিকে করে দেওয়া হয় ব্যান। এদের বিপ্লব সফল না হওয়ার আর একটি কারণ ছিল দেশভাগ। কারণ পার্টি যেখানে যেখানে বিল্পব শুরু করেছিল, স্বাধীনতার পরে সেই জায়গাগুলি পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়। যার পরে এরা স্বাধীনতাকেও মানতে অস্বীকার করে। সরকারকেও শোষকের আখ্যা দেয়।

এরপর সালটা ১৯৪৯। ভারত ব্যর্থ হলেও, প্রতিবেশী দেশ চিন শুরু করে রাশিয়ার স্টাইলে বিদ্রোহ। নেতৃত্ব দেন মাও জে দং। আর ১লা অক্টোবর, চিনে গঠিত হয় কমিউনিস্ট সরকার। এই বিদ্রোহের ফলে চিন থেকে শেষ হয়ে যায় জমিদারি প্রথা, মালিক শ্রেণীর অস্তিত্ব। যা দেখে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে ভারতের সিপিআই সদস্যরা। তারাও ভারতে একইভাবে বিপ্লব করে পরিবর্তন আনতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে।

কিন্তু, ততদিনে ভারতের সিপিআই নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদ দেখা যেতে থাকে ।

একদল দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে দেশে পরিবর্তন আনার পন্থা নেন। সফলও হয় উদ্দেশ্যে। ১৯৫১ সালের নির্বাচনে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়ে মূল বিরোধী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে সিপিআই। ১৯৫৭ সালে কেরালার বিধানসভা নির্বাচনও জিতে যায় তারা।

দলের অনেকেই এর বিরোধিতা করে, এবং সিপিআই ছেড়ে বেরিয়ে ১৯৬৪ সালের ৭ই নভেম্বর তৈরি করে নতুন দল সিপিআই (এম) অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট)

কিন্তু, এই দলের আরও কিছু সদস্যের মাথায় এখনও পর্যন্ত ঘুরছিল সশস্ত্র আন্দোলনের জেদ। লক্ষ্য ছিল লেনিন ও মাও জে দংয়ের মতো লড়াই করে সংস্কার আনা। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চারু মজুমদার। যার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আরও একটি দল। বিপ্লব আনার লক্ষ্যে চারু মজুমদার বিভিন্ন ডকুমেন্ট লিখে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করতে থাকে। যার ফলে পরবর্তীকালে সিপিআই এবং সিপিআই (এম) তাঁকে ব্যান করে দেয়।

কিন্তু, এখন প্রশ্ন – মার্ক্সবাদীরা কীভাবে হয়ে গেল নকশাল কিংবা মাওবাদী?

সালটা ১৯৬৭। ওই বছরেই পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় আসে সিপিআই। আর ওই বছরেই রাজ্যের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি নামক এলাকার নকশালবাড়ি গ্রামে ঘটে যায় একটি ভয়ানক ঘটনা। যা বদলে দেয় সারা ভারতের ইতিহাস। এই গ্রামে সাধারণত বাস করতেন বিভিন্ন ধরনের আদিবাসীরা। যাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষই জমিদারের জমিতে কাজ করতেন। আর নিপীড়িত হতেন। এই গ্রামে বিমল কিশান নামে এক কৃষকের জমি, ঈশ্বর টিরকি নামের এক জমিদার গায়ের জোরে হাতিয়ে নেন। তাকে মারধর করে জমি থেকে উৎখাত করে দেয়। আর এই ঘটনাই নকশালবাদের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। এই বিমল কিশানকে তার জমি ফিরিয়ে দিতে জঙ্গল সাঁওতাল, চারু মজুমদার, কানু সান্যালের নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা ওই জমিদারকে মারধর করে এবং লুটপাট চালায়। কিন্তু, ঘটনা এখানেই শেষ হয় না। সেই থেকে আগামী তিন মাস ধরে একের পর এক জমিদারকে মারতে শুরু করে তারা। পোড়াতে থাকে জমির দলিল।

এরপর পুলিশ এসে প্রতিবাদীদের থামাতে গেলে, পুলিশ ও জনতার মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৯৬৭ সালের ২৪শে মে এই বিদ্রোহে সোনম ওয়াংড়ি নামের একজন পুলিশের মৃত্যু হয়। আর এর পরের দিন অর্থাৎ ২৫শে মে, পুলিশ নকশালবাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে এবং প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালায়। যার ফলে ১১ জন মারা যায়। যার মধ্যে ৯ জন মহিলা এবং দুজন শিশু ছিল। সরকার কড়া হাতে এই প্রতিবাদ দমন করে।

কিন্তু ততদিনে এই বিদ্রোহের আগুন নকশালবাড়ি থেকে শুরু করে বিহার, ওড়িশা, অন্ধ্র প্রদেশের মতো রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে একইরকমভাবে কৃষক ও আদিবাসিরা শোষিত হচ্ছিল।

যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি থেকে মাও জে দঙয়ের স্টাইলে এই বিপ্লব করা হয়, তাই এর নাম হয় নকশালবাদ। আর যারা এই বিপ্লব করতো তাদের নাম হতো নকশালবাদী। যেহেতু এরা মাও জে দঙয়ের নীতি অনুসরণ করতো, তাই এদেরকে অনেকে মাওবাদীও বলা শুরু করেন। ধীরে ধীরে এই ভাবধারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

এরপর ১৯৬৯ সালের ২২শে এপ্রিল। ভ্লাদিমির লেনিনের শততম জন্মদিনে কলকাতায় চারু মজুমদারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) অর্থাৎ CPI(ML)। ধীরে ধীরে এই দলে যোগ দেয় প্রায় ১৭,০০০ মানুষ। সারা দেশের জমিদারদের ওপর চলতে থাকে অরাজকতা, খুন, লুঠপাট।

এরপর শক্ত হাতে সরকার এই বিপ্লবের দমন করা শুরু করে, গ্রেফতার হয় অনেকে। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে এই বর্বরতা আটকাতে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় অপারেশন স্টিপলচেজ। যেখানে প্রায় ২০,০০০ সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়। আর জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায় চারু মজুমদারের ঠিকানা। এরপর ১৯৭২ সালের ১৬ই জুলাই চারু মজুমদারকে গ্রেফতার করা হয়। এবং ২৮শে জুলাই লাল বাজারের কারাগারে তার মৃত্যু হয়। জানা যায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার ওপর অত্যচারের ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে অফিসিয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী, তাঁর TB ছিল, এবং জেলে তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান।

চারু মজুমদারের মৃত্যুর পরেও শেষ হয় না অভিযান। একের পর এক অপারেশন চালিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নকশালবাদীদের ধরপাকড় শুরু হয়। অনেকে ভয়ে গা ঢাকা দেয়। ফলত এক সময় কিছুটা হলেও ধিমিয়ে পড়ে নকশালবাদের আগুন।

কিন্তু ১৯৭৭ সালে, সেই আগুনে ফের ঘি ঢালার কাজ করে বিজেপি। ওই বছরের ২৪শে মার্চ দেশের মধ্যে ক্ষমতায় আসে বিজেপি অর্থাৎ তখনকার জনতা পার্টি। আর প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই। যিনি ক্ষমতায় আসার আগেই কথা দিয়েছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে জরুরী অবস্থার পরিস্থিতি সামাল দেবেন, এবং জরুরী অবস্থার সময় গ্রেফতার হওয়া সমস্ত আন্দোলনকারী এবং রাজনৈতিকভাবে গ্রেফতার হওয়া ব্যাক্তিদের মুক্তি দেবেন।

এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নকশালবাদীরা, মোরারজি দেশাইকে একটি চিঠি লিখে নিজেদের হাতিয়ার ত্যাগ করার কথা জানান, এবং অনুরোধ করেন তাদের গণতান্ত্রিক সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। যা মোরারজি দেশাই মেনে নেন। এবং ছেড়ে দেওয়া হয় গ্রেফতার হওয়া প্রায় সমস্ত নকশালবাদীকে। আর এরপরেই ছাড়া পায় অন্যতম নকশালবাদী নেতা কোণ্ডাপল্লি সিথারামাইয়া। যিনি বেরিয়েই গোপনে ছোট ছোট ৩০-৪০টি নকশালবাদ গ্রুপকে এক জায়গায় আনেন। এবং প্রায় ৩০,০০০ লোককে জড়ো করে ১৯৮০ সালে শুরু করে পিপলস ওয়ার গ্রুপ। এটাই ছিল প্রথম ভুল, যা নকশালবাদকে দিয়েছিল এক বিরাট হাওয়া।

দ্বিতীয়, একটি কারণ ছিল নিপীড়ন। আমাদের দেশে যত আদিবাসী ছিল তাদের প্রত্যেকের সাথেই করা হত নিপীড়ন। দারিদ্রতা, বেকারত্ব, এবং অভাব-অনটন তো ছিলই, সাথে আমাদের দেশের সরকার এদের অবহেলাও করতো। তাদের কাছে না ছিল পরিষ্কার জল, রাস্তা, হাসপাতাল, না ছিল স্কুলের সুবিধা। থাকলেও সেখানে এদের ওপর করা হত অত্যচার, শোষণ। ল্যান্ড রিফর্ম আইন হোক বা পঞ্চম তফসিল – কোনও কিছুই লাগু হতো না।

সরকার আর আদিবাসীদের এই দূরত্বের সুযোগ নেয় কোণ্ডাপল্লি সিথারামাইয়া। শুরু হয় সরকারকে নিয়ে ভুল বোঝানো। তাদের সাথে থেকে তাদের সমস্যা সমাধান করার উদ্যোগ নেয় সিথারামাইয়া সহ অন্যান্য মাওবাদী নেতারা, শেখানো হয় ওই সমস্ত অভেলিত মানুষদের প্রতিবাদ করানো। তাদের ভাষা শিখে তাদের সাথে ধীরে ধীরে মিশে যেতে শুরু করে এই সমস্ত নকশালবাদীরা। আর ধীরে ধীরে এই সমস্ত আদিবাসীরাও শুরু করে তাদের সমর্থন করতে। আর এইভাবেই নকশালবাদীরা ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, সহ বহু রাজ্যের ঘন জঙ্গলের আদিবাসীদের সাথে মিশে যায়। আর ম্যাপে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে নেপাল বর্ডার পর্যন্ত এই জায়গাগুলিকে একসাথে বলা হত রেড করিডোর।

ধীরে ধীরে ভারতের মধ্যেই নিজেদের সরকার শুরু করে মাওবাদীরা! শুরু হল ভারত শাসন।

নকশালবাদ এতো বৃদ্ধি পেতে থাকে যে ২০০৪ সালে জন্ম নেয়, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মাওইস্ট)। জানা যায় এই সময়ে দেশের ১০টি রাজ্যের ১৮০টি জেলা ছিল মাওবাদীদের অধীনে। ACLED-র তথ্য অনুযায়ী। সারা দেশের ৯২,০০০ স্কোয়ার কিমি জায়গা অর্থাৎ দেশের ৪০ শতাংশ জমি ছিল মাওবাদীদের অধীনে। যারা আলাদা পতাকা নিয়ে দেশের মধ্যেই চালাত আলাদা সরকার। যেখানে নিজেদের স্কুল থেকে শুরু করে খাদ্য এবং শস্য ব্যাঙ্ক, কোর্ট সবকিছুই ছিল। আর এই সরকারের একটি নামও ছিল – জনতা সরকার

২০০৬ সালে মনমোহন সিংয়ের সরকার নকশালদের সবথেকে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি বলে ব্যখ্যা করেন।

কিন্তু, কেন হঠাৎ করে মাওবাদীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সাধারণ মানুষ?

এত বৃদ্ধির পরেও ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে নকশালবাদ। যার মূল কারণ ছিল তারা নিজেই। কারণ তাদের বিদ্রোহের ফলে পুলিশ ও সরকার তো বটেই, সাফার করছিলেন সাধারণ মানুষ থেকে আদিবাসীরাও। অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে মানুষ এবং অধিবাসীরা এই পন্থা থেকে স্বাভাবিক সমাজে ফিরে আসতে চায়। যার মূল কারণ ছিল সরকারি একাধিক স্কিম। অনেকেই আবার বেছে নেন উন্নত জীবন যাপনের লক্ষ্য।

চলত শিক্ষিত সমাজকেও আক্রমণ, ফলত জন্ম নেয় আরবান নকশালিজম!

জানলে অবাক হবেন, বর্তমানে আমাদের দেশের বাইরের জঙ্গিরা যেমন দেশের ভিতরের শিক্ষিত সমাজকে বেছে নিচ্ছে আক্রমণ করার জন্য। তেমন এই মাওবাদীরাও তখনকার দিনে শিক্ষিত সমাজের ব্যাক্তিদের টার্গেট করে তাদের কাছে আশ্রয় নিতেন, তাদের সুবিধা নিতেন। একাধিক শিক্ষিত ব্যাক্তির ল্যাপটপ, ইমেল অনুসন্ধান করে দেখা যায়, এই সমস্ত নকশালবাদীরা শহরের মধ্যেও নিজেদের ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। যাদের মধ্যে ছিল উকিল, শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার সহ অনেকে। যাদের বলা হত আরবান নকশাল

তবে, জানলে অবাক হবেন, এখনও শেষ হয়নি এই আরবান নকশালিজম। সম্প্রতি বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছে এই সমস্ত মাওবাদীদের প্রতি সমর্থন, সহানুভূতিমূলক কর্মকাণ্ড। সম্প্রতি ২০২৫-এর নভেম্বর মাসে শেষ করে দেওয়া হয় মাওবাদীদের অন্যতম কুখ্যাত নেতা মাডবী হিডমাকে। কিন্তু, দিল্লিতে দূষণবিরোধী আন্দোলনে হঠাৎ করে হিডমার সমর্থনে দেখা যায় শ্লোগান। হাজার-লক্ষ হিডমা তৈরির আওয়াজ।

অন্যদিকে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকানন্দ অডিটোরিয়ামে রেভোলিউশনারি স্টুডেন্ট ফ্রন্টের একটি সম্মেলন হয়। সেখানে ওই ফ্রন্টের তরফ থেকে প্রতীকীভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় হিডমা নগর। পাশাপাশি কলকাতার প্রতীকী নামকরণ করা হয় কোটেশ্বর রাও নগর। আর বিবেকানন্দ অডিটোরিয়ামের প্রতীকী নামকরণ করা হয় বাসবরাজু অডিটোরিয়াম। এরা প্রত্যেকেই মাওবাদীদের শীর্ষ নেতা!

এত অপারেশন, সরকারি বিভিন্ন স্কিমের পরেও কেন দেশ থেকে শেষ হল না মাওবাদ?

নকশালবাদ বাড়ার মূল কারণ শুধু যে দারিদ্রতা, বেকারত্ব, এবং অভাব-অনটন তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশের এবং বাইরের বেশ কিছু মানুষ এই বর্বরতাকে দিতে থাকে হাওয়া। কখনও বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে এই সমস্ত মাওবাদীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। আবার বাইরের কিছু দেশ থেকে দেওয়া হত উন্নত মানের হাতিয়ার। পাশাপাশি দেশের একাধিক NGO থেকে দেওয়া হত আর্থিক সাহায্য। বেশ কিছু সাংদবাদিকরা মাওবাদীদের পক্ষ নিয়ে চালাত একাধিক সহানুভুতিমূলক ভাবনা। এছাড়াও, আমাদের দেশের মূল সমস্যা ছিল কোরাপশন। যার ফলে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়েছে।

অনেকেই এসব ঘটনা অস্বীকার করে। কিন্তু ভাবুন একটা কথা – যারা ঘন জঙ্গলে থাকে, যাদের সাথে ছিল আদিবাসী এবং গরীব মানুষেরা, তারা কীভাবে এত লোকের পোশাক, অস্ত্র, খাবার জোগাড় করতো? তোলাবাজি করে দেশের ১০টি জেলায় কি চালানো সম্ভব এত বড় মাপের সংগঠন?

২০১৪ সালের পর কী এমন হল, যে পাল্টে যেতে থাকল ছবিটা?

শুরুতেই বেশ কিছু তথ্য দিলে বুঝতে পারবেন যে আদৌ কীভাবে কমতে শুরু করেছে মাওবাদী ঘটনা।

Ministry of Home Affairs-এর তথ্য অনুযায়ী –

যেখানে ২০১৩ সালে ভারতের ১০টি রাজ্যের ১২৬টি জেলায় ছিল মাওবাদীদের প্রভাব,
সেখানে ২০২৪ সালে ভারতের নয়টি রাজ্যের ৩৮টি জেলায় রয়েছে মাওবাদীদের প্রভাব।

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী,

যেখানে ২০০১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত, মোট ৩,৫৪৯টি মাওবাদী ঘটনা দেখা গিয়েছে।
সেখানে ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত, মাত্র ১৮৫৬টি ঘটনা দেখা গিয়েছে।

যেখানে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত, মাওবাদী হামলায় সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনী মিলিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৬,৬৫৯ জনের।
সেখানে ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত, এই সংখ্যাটা মাত্র ১৫৪২।

এর কারণ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিজেপি সরকার একাধিকবার এই মাওবাদ ও নকশালবাদ শেষ করার ডাক দিয়েছে। অমিত শাহ বলেছেন, “২০২৬ সালের ৩১ মার্চ, দেশে মাওবাদের অন্তিম দিন হতে চলেছে। তার আগেই আমরা দেশ থেকে মাওবাদীদের পুরোপুরিভাবে শেষ করবো।’’

কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার?

প্রথমত, একের পর এক র‍্যাপিড অপারেশন

মাওবাদীদের শেষ করার লক্ষ্যে শুরু হয়েছে একের পর এক অপারেশন, যেমন অপারেশন প্রহার, অপারেশন সমাধান, অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট। শুরু করা হয়েছে বস্তার ফাইটার ফোর্স, যেখানে স্থানীয়দের নেওয়া হচ্ছে। যারা এই সমস্ত জঙ্গলকে ভালোভাবে চেনেন। তাদেরকে, মাওবাদীদের মতোই গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বস্তারে ১০০টি পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে। যার ফলে মারা গিয়েছে একাধিক শীর্ষ মাওবাদী নেতা।

দ্বিতীয়ত, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার

মাওবাদী নির্মূল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী শুরু করেছে ধারাবাহিকভাবে চাপ দেওয়া। মাওবাদীদের ধরার জন্য শুরু করেছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার। ড্রোন, হেলিকপ্টার দিয়ে চালানো হচ্ছে অপারেশন। আগে যে সমস্ত জঙ্গলেরর ম্যাপ থাকতো না নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে, এখন স্যাটেলাইট সিস্টেম ব্যবহার করে সেই সমস্ত জায়গার ম্যাপ তৈরি করছে সরকার। বসাচ্ছে মোবাইল নেটওয়ার্ক।

তৃতীয়ত, ফান্ডিং আঁটকে দেওয়া

কেন্দ্রীয় সরকার, FCRA আইনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা শুরু করে। যার ফলে সমস্ত NGO-র আর্থিক গতিবিধির ওপর রাখা হয় কড়া নজরদারি, ফলত ধীরে ধীরে আঁটকে যায় মাওবাদের ফান্ডিং।

এছাড়া, ২০১৬ সালের নোটবন্দীর ফলেও এক বড়সড় ঝটকা খায় মাওবাদীদের ফান্ডিং।

চতুর্থত, সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি

আগের বিভিন্ন সরকারের বিপরীতে এই সরকার সাধারণ মানুষের কাছে আসা শুরু করে। এই সমস্ত মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখা শুরু করে। বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক চাহিদা যেমন জল, বিদ্যুৎ, স্কুলের মতো বিভিন্ন সুবিধা উপলব্ধ করানো হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে কাজের জন্য প্রশিক্ষণ। তৈরি হচ্ছে বড় বড় রাস্তা। একাধিক সুযোগ-সুবিধা।

পঞ্চমত, আত্মসমর্পণ করলেই স্পেশাল সুযোগ-সুবিধা

কখনও হাতে আবার কখনও ভাতে মেরে – এক প্রকার নিরুপায় করে দেওয়া হচ্ছে মাওবাদীদের। যে কারণে তারা বাধ্য হচ্ছে আত্মসমর্পণ করতে। আর এই আত্মসমর্পণ বাড়াতেই দেওয়া হচ্ছে বেশ কিছু লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা। যেমন – ৫ থেকে ৮ লক্ষ টাকা নগদ ইনসেন্টিভ, বাড়ি করার জন্য জমি, ভোকেশনাল ট্রেনিং, বাচ্চাদের জন্য শিক্ষা, দেওয়া হচ্ছে আইনি সুবিধাও। এবং দেখা গিয়েছে এই নীতির অধীনে অনেকেই আত্মসমর্পণ করে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়েছেন।

একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ সালের মে মাস থেকে ২০২৫ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোট ৮,৭৫১ জন নক্সাল/মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছে। ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে, প্রায় ৫০০ জন মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছেন।

অর্থাৎ, লক্ষ্য শেষ হতে বাকী আর মাত্র ৪ মাস। তার মধ্যে কী আদেও শেষ হবে মাওবাদ? মাওবাদ ভালো না খারাপ? দিল্লিতে যারা বলছে আরও জন্মাবে হিদমা – তাদের নিয়েই বা আপনার কী মতামত?

Leave a Comment