আগামী আট সপ্তাহের মধ্যে দিল্লি এবং এনসিআর এলাকার সমস্ত পথ কুকুরদের ডগ শেল্টারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট (Stray Dogs Supreme Court)। গত ১১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল সুপ্রিম কোর্ট? কেনই বা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হল এই রায় নিয়ে? কোন মডেলে পথ কুকুরদের সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে?
আজ এক এক করে পথ কুকুর সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য আমরা তুলে ধরেছি India Hood-এর এই প্রতিবেদনে।
পথ কুকুরদের নিয়ে কেন এমন সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের?
ঘটনার সূত্রপাত ৩০ জুন। ছাভি শর্মা নামের ৬ বছর বয়সী এক শিশুকে হঠাৎ করেই কামড়ে নেয় একটি পথ কুকুর। রক্তাক্ত অবস্থায় তার চিকিৎসার জন্য তাকে তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হয় ডাঃ বি.আর. আম্বেদকর হাসপাতালে। প্রাথমিকভাবে সবকিছু ঠিক থাকলেও, গত ২১ জুলাই, স্কুল থেকে ফিরেই বমি করতে শুরু করে ওই শিশু, হারিয়ে ফেলে গায়ের সমস্ত জোর, বন্ধ করে দেয় কথা বলাও। এরপর ২৫ জুলাই, শেষ টিকার নেওয়ার আগেই মৃত্যু হয় ওই শিশুটির।
এই নিয়ে ২৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে একটি সুয়ো মোটো মামলা দায়ের হলে, ওই মামলার শুনানিতে ১১ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জে বি পাদ্রীওয়ালা ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চ এই ঘটনাকে “খুবই বিরক্তিকর এবং উদ্বেগজনক” আখ্যা দিয়ে কুকুদের সেল্টারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ঃ
১১ আগস্ট, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে জানিয়েছে, “কর্তৃপক্ষকে সমস্ত কুকুরদের টিকা দিতে হবে। তাদের শেল্টারে পাঠাতে হবে। নয়ডা, গাজিয়াবাদ, গুরুগ্রাম সহ যেখানে শেল্টার নেই, সেখানে ডগ শেল্টার তৈরি করতে হবে। এই সব শেল্টারে কুকুরদের সামলানোর জন্য পেশাদারদের রাখতে হবে। সমস্ত শেল্টারে বাধ্যতামূলকভাবে ক্যামেরা বসাতে হবে। কুকুর কামড়ানোর ঘটনার ক্ষেত্রে চালু করতে হবে হেল্পলাইন।“ পাশাপাশি র্যাবিসের ভ্যাকসিন নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে ওই রায়ে। প্রয়োজনে তৈরি করতে বলা হয়েছে বিশেষ বাহিনীও।
এই রায় দেওয়ার সময় বিচারপতি পাদ্রীওয়ালা জানিয়েছেন, “আপাতত সব নিয়ম ভুলে সমস্ত পথ কুকুরদের দূরে কোথাও নিয়ে যান। জলাতঙ্কে আক্রান্তদের কি পশুপ্রেমীরা কি ফিরিয়ে আনতে পারবে? পথকুকুরদের দত্তক নেওয়াও বন্ধ। কোন মূল্যেই শিশু এবং ছোট বাচ্চাদের র্যাবিস আক্রান্ত হওয়া কাম্য নয়… এই পদক্ষেপের মাধ্যমে এবার থেকে শিশুরা কোন রকম ভয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে।” এর শাপাশি তিনি জানিয়েয়েছেন, “এই বিষয়ে কারোর কোনও আপত্তি শুনতে চাই না। আদালতের এই উদ্যোগে বাধা সৃষ্টি করলে তাকে আদালত অবমাননা বলেই মনে করা হবে।“
ছাভি নয়, কুকুর আক্রান্তদের তালিকা অনেক বড়!
ভারতে পথ কুকুরদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শুধু দিল্লিতেই এই সংখ্যা ১০ লক্ষ। দিল্লি পুরসভার একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে মোট ৪৯টি র্যাবিস কেসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই ৬ মাসে দিল্লিতে ৩৫,১৯৮ জনকে কুকুরে কামড়েছে। ২০২৪ সালে দেশে ৩৭ লক্ষেরও বেশি কুকুরের কামড়ের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জলাতঙ্ক রোগে ৫৪ জন মারা গেছেন।
নেদারল্যান্ডস এবং ভুটান খুব দক্ষতার সাথে এই সমস্যার সমাধান করেছে!
ইউরোপের প্রথম দেশ হিসাবে নেদারল্যান্ডসই পথ কুকুরদের নিয়ে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করেছিল। একসময়ে নেদারল্যান্ডসেও পথ কুকুরদের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি ছিল। সেই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার প্রথমেই কুকুরদের সাথে খারাপ ব্যবহার করাকে অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করে। দ্বিতীয়ত, স্টোর থেকে কুকুর কেনার বিরুদ্ধে ভারী শুল্ক চাপানো হয়, যাতে সাধারণ মানুষ পথ কুকুরদের দত্তক নেয় বেশি করে। এছাড়া, তাদের টীকা এবং স্টেরালাইজেশন করা হয়। ভুটানেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের দাবি –
১. সমস্ত কুকুরদের পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নেই। সুপ্রিম কোর্ট সমস্ত কর্পোরেশনগুলিকে শেল্টার তৈরি করার এবং পথ কুকুরদের স্থানান্তরের জন্য মাত্র ৮ সপ্তাহ সময় দিয়েছে। অনেকের দাবি, মাত্র ৮ সপ্তাহ এই কাজ করার জন্য যথেষ্ট নয়।
২. সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট অভাব থাকার ফলে পথ কুকুরদের জীবনহানি হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
৩. এটি দুর্নীতির একটি সুবর্ণ সুযোগ বলে মনে করছেন অনেকেই। কারণ এই খাতে সমস্ত করদাতার অর্থ, পথ কুকুরের যত্ন নেওয়ার খরচ হিসাবে দেখানো হবে। আর কয়েকশো কুকুরের জায়গায় কয়েক হাজার কুকুরকে জোর করে রেখে পরিস্থিতি আরও খারাপ করা হবে।
এই রায়ে সামনে আসার পর থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন সমাজসেবী, পশুপ্রেমী থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরোধিতা করেছেন। যার ফলে সুপ্রিম কোর্ট এই রায় পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে, প্রশ্ন একটাই, এই রায়ের ফলে পথ কুকুরদের থেকে সাধারণ মানুষ কিছুটা মুক্তি পেলেও, ওই অবলা প্রাণীদের কি সুরাহা হবে?