বেছে বেছে, কালো কালি দিয়ে মার্ক করে, আগুন লাগানো হয় হিন্দুদের বাড়িতে, কেটে দেওয়া হয় জলের লাইন, যাতে আগুন না নেভানো যায়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় সমস্ত মহিলাদের জামা-কাপড়, যাতে পালানোর সময় নগ্ন হয়ে পালাতে বাধ্য হয় বাড়ির মহিলারা।
মাস তিনেক আগে এমনই নৃশংস ঘটনার সাক্ষী ছিল মুর্শিদাবাদের বহু গ্রাম (Murshidabad Violence)। ধুলিয়ান, সামশেরগঞ্জ, বেতোবনা সহ বিভিন্ন এলাকায় বর্বরোচিত আক্রমণ করা হয় হিন্দুদের ওপর। আর এই ঘটনার তদন্ত করার জন্য কলকাতা হাইকোর্টের তরফ থেকে গঠন করা হয় স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম অর্থাৎ SIT – আর সেই SIT-র রিপোর্ট থেকে উঠে আসছে হাড় হিম করা তথ্য। যেখানে জানা যাচ্ছে কতটা সুপরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটানো হয়।
কীভাবে ঘটল এই ঘটনা? কারা প্ল্যান করেছিল এই “সুপরিকল্পিত আক্রমণ“? এর পেছনে কে আসল মাস্টারমাইন্ড? চলুন জেনে নেওয়া যাক সম্পূর্ণ সত্যিটা।
প্রেক্ষাপট
সালটা ২০২৫-এর ৩রা এপ্রিল। টানা ১২ ঘণ্টা আলোচনার পর “লোকসভায়” পাশ হয় ওয়াকফ সংশোধনী বিল। এরপর ৪ঠা এপ্রিল। গভীর রাতে “রাজ্যসভায়” বেশ কিছু সংশোধন করে পাশ হল ওয়াকফ বিল। ১৯৫৪ সালের এই আইন ১৯৯৫ সালেও একবার সংশোধন করা হয়। তখন ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা কিছুটা বাড়িয়েছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। কিন্তু ২০২৫ সালে অনেকটাই বদলে গেল বোর্ডের ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা। অনেকের দাবি, ‘নতুন বিলে অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা।‘
এরপর ৬ই এপ্রিল। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওই বিলে সই করেন দেশের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।
এরপর ৮ই এপ্রিল। সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার পর বিলটি ওয়াকফ আইন হিসাবে কার্যকর করা হয়।
এই আইন অনুযায়ী, এবার থেকে যে কোনও সম্পত্তিকে আর নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করতে পারবে না ওয়াকফ বোর্ড। এবার থেকে জেলা শাসক, ওয়াকফ বোর্ডের যে কোন দাবি প্রথমে পর্যালোচনা করবেন, এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। নতুন আইন অনুযায়ী, এবার থেকে ওয়াকফ কাউন্সিলে সর্বাধিক ৪ জন অ-মুসলিম প্রতিনিধি এবং ২ জন মহিলা প্রতিনিধিও থাকবেন।
এরপর, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। অনেকেই বেছে নেনে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের রাস্তা। কিন্তু, কেউ কেউ আবার বেছে নেন সহিংস প্রতিবাদের রাস্তা। যার রেশ দেশের অন্যান্য রাজ্যের পাশাপাশি এসে পড়ে পশ্চিমবঙ্গেও।
ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদের হিংসার আগুন পশ্চিমবঙ্গে
ওয়াকফ সংশোধনী আইনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নানা ধরনের বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটতে থাকে। হিংসাত্বক প্রতিবাদ শুরু হয় জঙ্গীপুর, উমরপুর, হুগলির বৈদ্যবাটি সহ একাধিক জায়গায়। কিন্তু, এরপর মুর্শিদাবাদে যা ঘটে, তা গোটা বাংলার ভিত নাড়িয়ে দেয়।
দিনটা ১১ই এপ্রিল। মুর্শিদাবাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হঠাৎ করেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
এই জেলার শামসেরগঞ্জ, সুতি, বেতবোনা ও ধুলিয়ান হঠাৎ করেই যেন মৃত্যুপুরীর রূপ নেয়। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে হিন্দুদের ঘর, ভেঙে দেওয়া হয় দোকান, চুরি করা হয় টাকা-গয়না, পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস। কাশ্মীরের যে পাথরবাজি এতদিন খবরের কাগজের পাতায় পড়ে আর টেলিভিশন-সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে আসছিল মানুষজন, এপ্রিল মাসের ১১ ও ১২ তারিখে ওই একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় সেখানকার হিন্দুরা। শয়ে শয়ে মুখোশধারী মানুষের আক্রমণে ঘরছাড়া হয় কয়েক’শো হিন্দু।
শুধু তাই নয়, জাতীয় সড়ক অর্থাৎ NH12 অবরোধ করে আক্রমণ চালানো হয় পুলিশের ওপর, গাড়িতে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। প্রতিরোধের ফলে বিপর্যস্ত হয় নিমতিতা রেল স্টেশনের ট্রেন চলাচল।
এই ঘটনায় মৃত্যু হয় ৩ জনের, গুরুতর আহত হন ১০ জনেরও বেশি হিন্দু সহ ১৬ জন পুলিশকর্মী। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় প্রায় ২০০ জনের বেশি মানুষকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। হাইকোর্টের তরফ থেকে মোতায়েন করা হয় BSF।
এরপর ১৭ই এপ্রিল, এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের জন্য কলকাতা হাইকোর্টের তরফ থেকে একটি বিশেষ তথ্য অনুসন্ধান কমিটি অর্থাৎ SIT গঠন করা হয়।
এই SIT-র সদস্য হিসাবে রাখা হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রেজিস্ট্রার যোগিন্দর সিং; পশ্চিমবঙ্গ আইনী পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সদস্য সচিব সত্য অর্ণব ঘোষাল, এবং পশ্চিমবঙ্গ বিচার বিভাগীয় পরিষেবার রেজিস্ট্রার সৌগত চক্রবর্তী। ওই ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু করে ওই কমিটি।
তদন্তে উঠে আসে বিস্ফোরক তথ্য
এরপর প্রায় এক মাস পর, ২০ মে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে ১৩ পাতার একটি রিপোর্ট জমা দেয় SIT। এই রিপোর্টে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন প্রতক্ষ্যদর্শী, যারা ওইদিন ঘটনা স্থলে ছিলেন, আক্রমণ হতে দেখেছেন, তাদের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অভিযোগ এখানে তুলে ধরা হল –
প্রথমত, একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সামশেরগঞ্জ, হিজলতলা, শিউলিতলা, ডিগ্রি থেকে একাধিক মানুষ মুখোশ পরে আক্রমণ করতে আসে। ১১ই এপ্রিল, আক্রমণকারীদের সাথে এসেছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর মেহবুব আলম। বিধায়কও ওইদিন ওখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি হিংসা দেখেও মুখ বন্ধ করে চলে গিয়েছিলেন। ১২ই এপ্রিলও হিংসা জারি ছিল। এরপর ঝামেলা কিছুটা কমলে, আমিরুল ইসলাম নামক একজন ব্যাক্তি এসে দেখেন কোন কোন বাড়িতে আগুন লাগানো হয়নি। যার পর দুষ্কৃতিরা এসে ওই বাড়িগুলিতে আগুন লাগায়।
দ্বিতীয়ত, আর একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ১১ই ও ১২ই এপ্রিল বেতবোনা গ্রামের বাসীরা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে দুদিন বিকেল ৪টের দিকে ফোন করলে পুলিশ সেই ফোনই ধরেনি।
তৃতীয়ত, অন্যদিকে আর একজন ব্যাক্তি জানান, আমাদের সবাইকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেওয়া হয়। সাথে পেট্রোল ঢেলে জ্বালানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, আমরা বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু পুলিশ আমাদের উদ্ধার করেনি, BSF করেছে।
সুশান্ত মণ্ডল নামের একজন গ্রামবাসী এবং যিনি নিজেও একজন BSF জওয়ান ওই হামলায় আহত হন।
একজন অভিযোগকারিণী জানান, আমাদের জামাকাপড়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, যাতে আমরা কিছু পরতে না পারি।
SIT রিপোর্টে আরও উঠে আসছে –
১১৩টি বাড়ি ধূলিসাৎ করা হয়েছে, লক্ষ্য করা হয়েছে হিন্দু মন্দিরগুলিকেও। আক্রমণকারীরা জলের লাইন কেটে দেওয়া হয়, যাতে কেউ আগুন নেভাতে না পারে।
১২ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত স্টাইল বাজার ভাঙচুর করা হয় এবং সেখান থেকে একাধিক সামগ্রী চুরি করা হয়।
দোকান ভাঙা হয়, পুড়িয়ে দেওয়া হয় দরকারি কাগজপত্র।
ডেমোক্রেটিক নিউজ টিভি, News9-এর বিস্ফোরক তথ্য
ইন্টালিজেন্স এজেন্সির বরাত দিয়ে ডেমোক্রেটিক নিউজ টিভি, News9-এর রিপোর্ট জানাচ্ছে –
১। ঘটনার তিন মাস আগে থেকেই এই আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়।
২। তুরস্ক থেকে টাকা এসেছে এই হামলার জন্য।
৩। বাংলাদেশের আনসার উল্লা বাংলা দলের দুই সদস্য মুর্শিদাবাদে আসে। এই গোষ্ঠী বাংলা এবং বিহারের সংখ্যালঘুদের সাথে যোগাযোগ রাখে। তারা জানিয়েছে, ঢাকার তুলনায় দ্বিগুণ হিংসা হবে। অনেকেই বোরখা পরে এসেছিলেন।
৪। মাদ্রাসা থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে আক্রমণকারীদের। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের জেল পলাতকরা এই আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে প্রত্যেককে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
৪। কলাগাছকে মানুষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে প্রত্যেককে পাথর ছোড়া শেখানো হয়েছে মালদা এবং মুর্শিদাবাদে।
৫। আক্রমণের ক্যাটালগ তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল, যার যত বেশি আক্রমণ হবে, সে তত বেশি টাকা পাবে।
৬। ১৫ থেকে ২১ বছরের যুবকদের বেছে নেওয়া হয়েছিল যাতে তাদের ধাওয়া করা হলে সহজেই পালাতে পারে।
এছাড়া, ২০২৪ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বরে আনসার উল্লাহ বাংলা দলের প্রধান জসিমঊদ্দিন রহমানির একটি ভিডিও খুবই ভাইরাল হয়। যার সাথে মুর্শিদাবাদ হামলার যোগ আছে বলে মনে করেন অনেকেই। যেখানে রহমানি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, নরেন্দ্র মোদীর হাত থেকে বাংলাকে স্বাধীন করার ডাক দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ইউনুস সরকারের সময়কালে আনসার উল্লাহ বাংলা দলের প্রধান জসিমঊদ্দিন রহমানিকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, এর আগে শেখ হাসিনা সরকারের সময় তাঁকে জেলে রাখা হয়েছিল।
রাজনীতিবিদদের মন্তব্যঃ
ওই SIT রিপোর্ট নিয়ে বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, এই রিপোর্ট থেক এটা স্পষ্ট যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিথ্যে কথা বলেছেন, এবং তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত।
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ জানিয়েছিলেন, সরকার সহ সবাই এই ঘটনার নিন্দা করেছে। পুলিশ প্রশাসন সহ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফ থেকে যা যা করার তা করার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। অপরাধীদের ধরার প্রক্রিয়া চলছে। বাইরে থেকে এসে আক্রমণের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। বিজেপি এই ঘটনা নিয়ে যে রাজনীতি করছে তা খুব নিন্দনীয়, আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি।
এর মধ্যে মন্তেশ্বরের তৃণমূল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আহমেদ হোসেন শেখ, এই ঘটনার জন্য দায় দেয় সিদিক্কুউলা চৌধুরি ও তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে।
তবে, একাধিক প্রশ্ন যার উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি!
প্রথম প্রশ্ন, রাজ্য সরকারের মতামত অনুযায়ী যদি বহিরাগতরা আক্রমণ করে, তাহলে প্রত্যক্ষদর্শীরা কীভাবে নাম ধরে ধরে অভিযোগ করেছেন? যার ফলে আক্রমণকারীদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকলেও পরোক্ষ যোগাযোগের তথ্য উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ঘটনাস্থল থেকে ৩০০ মিটারের দুরত্বে থানা থাকলেও, কেন কোন রকম সহায়তা এল না থানা থেকে? দুদিন এক টানা আক্রমণের পরে কেন নিস্ক্রিয় ছিল সেখানকার পুলিশ স্টেশন?
তৃতীয় প্রশ্ন, প্রত্যক্ষদর্শীদের তরফ থেকে নাম উল্লেখ করার পরেও কেন গ্রেফতার করা হল না মেহবুব আলমদের?
স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়েও আজ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? এই পশ্চিমবঙ্গে শুধু হিন্দুরাই কেন আক্রমণের লক্ষ্যে?
নিরাপত্তা যেমন দেরীতে এসেছে, তেমনই কি উত্তরও আসবে অনেক দেরীতে?