যুদ্ধের পর যুদ্ধ। কখনও ভারত-পাকিস্তান, কখনও বা রাশিয়া-ইউক্রেন, তো কখনও বা ইজরায়েল-ইরান। আর, এবার যুদ্ধে নেমে পড়েছে বৌদ্ধ ধর্মের দুই দেশ কম্বোডিয়া আর থাইল্যান্ড (Thailand And Combodia)। ঘর ছাড়া হাজার-হাজার মানুষ, নিঃস্ব কয়েক’শো পরিবার, মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়েছে কয়েক ডজন।
একই ধর্ম, একই জীবন শৈলী, একই পূজা পদ্ধতি অথচ সবকিছু ভুলে এবার যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছে দুই প্রতিবেশী দেশ। আর এই যুদ্ধের কেন্দ্রে – শিব মন্দির। কিন্তু, কেন দুই বৌদ্ধ ধর্মের দেশ, আজ লড়ছে হিন্দুদের শিব মন্দির নিয়ে? আজ কেন একে অপরের শত্রু হয়ে উঠল এই দুই দেশ? কীভাবেই বা শুরু হল এই যুদ্ধ? আজ এক এক করে সব তথ্য আমরা প্রকাশ করবো আপনাদের সামনে।
সময়টা আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগের…
কখনও উপনিবেশ হয়নি থাইল্যান্ড!
যখন একের পর এক দেশকে উপনিবেশ বানিয়ে যাচ্ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্স, তখন সুরক্ষিত ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র দেশ থাইল্যান্ড। সেই সময় ঐ দেশের নাম ছিল সিয়াম। রাজা রামা চতুর্থ ও রাজা রামা পঞ্চম পশ্চিমি শিক্ষা ও সংস্কার গ্রহণ করে দেশকে আধুনিক করে তোলেন, আবার অন্যদিকে চুক্তির মাধ্যমে দেশকে উপনিবেশ হওয়া থেকে রক্ষা করেন। এরপর ১৯৩৯ সালে সিয়ামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “থাইল্যান্ড”, যার অর্থ “স্বাধীনতার দেশ।” এখনও এই দেশে রাজতন্ত্র ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কিন্তু, রাজা রাষ্ট্রের প্রধান হলেও, বাস্তব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
তবে, কম্বোডিয়ার ইতিহাসটা একটু অন্যরকম –
সালটা ১৮৬৩। কম্বোডিয়ার রাজা নরোদম একটি সুরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিণত হয়। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা দেশ জুড়ে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। ফলত, ১৯৫৩ সালের ৯ই নভেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে এই দেশ। স্বাধীনতার পর রাজতন্ত্রের অধীনে থাকা এই দেশ নৃশংস গণহত্যার সাক্ষী হয়, যার পর ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়।
দুই দেশের সীমানা কীভাবে হয়ে উঠল দ্বন্দের কারণ?
কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের সীমানা নির্ধারণ করার জন্য একাধিকবার হস্তক্ষেপ করে ফ্রান্স। বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ হয়, যার মধ্যে বেশিরভাগ জায়গাই থাইল্যান্ডের থেকে জোর করে কম্বোডিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দ্বন্দের শুরুটা ১৯০৭ সালে। ফরাসি উপনিবেশ থাকার সময়ে কম্বোডিয়ার একটি মানচিত্র তৈরি হয়। এই মানচিত্রের কিছু অংশ নিয়ে বিরোধিতা করে থাইল্যান্ড। যার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল প্রিয়া ভিহার মন্দির। এই মন্দিরের অধিকার এবং সুরক্ষা প্রদানের দায়ভার কোন দেশের সেই নিয়েই শুরু হয় দ্বন্দ।
প্রিয়া ভিহার মন্দির –
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, প্রিয়া ভিহার মন্দিরটি একাদশ শতাব্দীতে রাজা প্রথম যশোবর্মণের রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। প্রিয়া ভিহার মন্দিরটির মূল নাম ছিল শ্রী শিখরীশ্বর, যার অর্থ ‘পর্বতের মহিমান্বিত প্রভু’। এই মন্দিরটি মূলত ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হলেও, পরে এটি বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, যা এটিকে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মের অনুসারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত করে।
সালটা ১৯৫৪। কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনের ৪০০ কিমি উত্তরে অবস্থিত প্রিয়া ভিহার মন্দিরটিকে হঠাৎ করেই দখল করে নেন থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী। আর সেটিকে দখল করে নিজেদের বলে দাবী তোলে।
এর ঠিক ৫ বছর পর সালটা ১৯৫৯। মন্দিরকে পুনরুদ্ধার করার জন্য ফ্রান্সের তৈরি বিভিন্ন নথি নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে হাজির হয় কম্বোডিয়া। তারা জানায় যে, মন্দিরটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে ১৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আংকর ওয়াট কমপ্লেক্সের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত।
এরপর দিনটা ১৯৬২ সালের ১৫ জুন। আন্তর্জাতিক বিচারালয় এই মন্দির নিয়ে রায় দেয়, “১৯০৭ সালে ফ্রাঙ্কো-সিয়ামিজ মানচিত্রের ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে এই মন্দিরটি কম্বোডিয়ার সীমান্তেই অবস্থিত।“ রায় দেওয়ার পরেই আদালত ওই জায়গা থেকে থাইল্যান্ডের সামরিক ও পুলিশ বাহিনী প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেয়, এবং ১৯৫৪ সাল থেকে ওই মন্দিরের চারপাশের ধ্বংসাবশেষ থেকে সরানো যে কোন জিনিস কম্বোডিয়ায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়। তবে, প্রিয়া ভিহার মন্দির মন্দিরের অবস্থান ও অধিকার নির্ধারণ করলেও, আন্তর্জাতিক বিচারালয় মন্দির সংলগ্ন ও চারপাশের ৪.৬ বর্গকিলোমিটার জায়গা কার, তা নির্ধারণ করে দেয়নি। ফলে, শুরু হয় এক নতুন সমস্যা।
এবার মন্দিরের দাবী কম্বোডিয়া করলেও, আশেপাশের জায়গার কর্তৃত্ব দাবী করতে থাকে থাইল্যান্ড। যা নিয়ে শুরু হয় নতুন বিবাদ।
এরপর সালটা ২০০৮। ওই বছরের জুলাই মাসে, UNESCO এই মন্দিরকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যা নিয়ে থাইল্যান্ডের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যার পর থাই সৈন্যরা প্রিয়া ভিহার মন্দির সংলগ্ন কেও শিখা কিরি স্বরা প্যাগোডা, অন্যান্য ছোট ছোট মন্দির, এবং আশেপাশের ৪.৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে। উত্তেজনা বাড়তে থাকায় উভয় দেশই সীমান্তে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে।
এরপর আগস্ট মাসে, থাই সৈন্যরা কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডের সীমান্তে ডাংরেক পর্বতমালায় অবস্থিত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির দখল করে, যার নাম তা মোয়ান মন্দির বা প্রসাত তা মোয়ান থম।
তা মোয়ান মন্দির বা প্রসাত তা মোয়ান থম –
প্রিয়া ভিহারের মতো এই মন্দিরটিও একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়, নির্মাণ করেছিলেন রাজা দ্বিতীয় উদয়াদিত্যবর্মণ। এই মন্দিরটিও ভগবান শিবের আরাধনার জন্য নিবেদিত ছিল। এখানের বেশিরভাগ মানুষ খেমার ভাষায় কথা বলে। যা মূলত কম্বোডিয়ার ভাষা। আবার অন্যদিকে মন্দিরের প্রবেশ পথ থাইল্যান্ডের দিকে, এবং কম্বোডিয়ার তুলনায় থাইল্যান্ড থেকে এই মন্দিরে প্রবেশ অনেক সহজ এবং ব্যবহারের যোগ্য। যার ফলে এটিও প্রিয়া ভিহারের মতো বিবাদমান হয়ে ওঠে, এবং উভয় দেশই এই মন্দিরকে নিজেদের বলে দাবী করে।
ফিরে আসি প্রসঙ্গে, আগস্ট মাসে, থাই সৈন্যরা প্রসাত তা মোয়ান থম দখল করলে, কম্বোডিয়া তা মোয়ান থেকে প্রায় তের কিলোমিটার পূর্বে আর একটি বিবাদমান মন্দির প্রসাত তা ক্রাবেই মন্দিরটি দখল করে। যার ফলে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়, কিন্তু সময়ের সাথে কয়েকদিনের মধ্যেই তা থেমে যায়।
এরপর ৩রা অক্টোবর, প্রসাত তা মোয়ান থম মন্দির নিয়ে পুনরায় সংঘর্ষ বাঁধে। যার ফলে মৃত্যু হয় একজন কম্বোডিয়ান সেনার, এবং আহত হন দু’জন থাই সৈনিক।
এরপর দিনটা ১৫ই অক্টোবর। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে ফের সংঘর্ষে লিপ্ত হয় উভয় দেশের সেনাবাহিনী। আঘাত হানা হয় রকেট-চালিত গ্রেনেড, মর্টার, এবং মেশিনগান দিয়ে। অবশেষে, সীমান্তে নিয়োগ করা কমান্ডারদের হস্তক্ষেপে এই উত্তেজনা শান্ত হয়।
এরপর সালটা ২০০৯। বছরের মার্চ মাসের শেষ এবং এপ্রিলের শুরুর দিকে, UNESCO-র কর্মকর্তারা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থানের নিয়মিত তত্ত্বাবধানের অংশ হিসাবে প্রিয়া ভিয়ার মন্দিরে একটি “পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ মিশন” পরিচালনা করেন। পরিচালনার পর রিপোর্টে জানানো হয়, ২০০৮ সালের ১৫ই অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে যে ঝামেলা হয়েছিল, তা থেকে মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৩রা এপ্রিল UNESCO-র কর্মকর্তারা পর্যবেক্ষণ শেষ করে চলে যাওয়ার পরপরই, বিতর্কিত এলাকায় প্রবেশাধিকার নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতবিরোধ বাধে, এবং অক্টোবর মাসে হওয়া সংঘর্ষের স্থান ফিল্ড অফ ঈগলসে ফের লড়াই বাঁধে দুই দেশের মধ্যে। এই সংঘর্ষে আগের থেকেও উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। যার ফলে এই সংঘর্ষে হতা-হতের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
ওই বছরেই, বেসামরিক ঠিকাদারদের নিয়োগ করে কম্বোডিয়ার সিয়েম রিপের আংকর ওয়াটের সাথে প্রিয়া ভিহার মন্দিরকে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কম্বোডিয়া, মন্দিরের আশেপাশের বিতর্কিত ৪.৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা দিয়ে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা তৈরি শুরু করে। যেহেতু ICJ কেবল মন্দিরের পার্শ্ববর্তী এলাকার কোন মালিকানা নির্ধারণ করেনি, তাই থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে ওই সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়িয়ে দেয়।
এরপর সালটা ২০১০। থাইল্যান্ডের দখল করা কাও শিখা কিরি স্বরা প্যাগোডা নিয়ে কম্বোডিয়ার সাথে শান্তিপূর্ণ আলোচনা সারে থাইল্যান্ড। যার পরে ১লা ডিসেম্বর, ওই জায়গা ছেড়ে চলে যায় থাই সৈন্যরা। কিন্তু ফের অজানা কারণে উত্তেজনা শুরু হয় সীমান্তে।
এরপর সময়টা ২০১১ সালের জানুয়ারি মাস। থাই সেনাবাহিনী হাইওয়ে ২২১ থেকে কাও শিখা কিরি স্বরা প্যাগোডার দিকে একটি স্পার তৈরি করার জন্য ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু করে। কম্বোডিয়া এই স্পার তৈরির তীব্র প্রতিবাদ করে এবং নির্মাণ বন্ধ করার অনুরোধ জানায়।
কিন্তু, কম্বোডিয়ার এই ধরনের অনুরোধে মনোযোগ দেওয়ার অর্থ মন্দিরের ৪.৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাটি যে কম্বোডিয়ান অঞ্চল তা স্বীকার করে নেওয়া। কূটনৈতিকভাবে এটি থাইল্যান্ডের পরাজয় হত। তাই থাইল্যান্ড এই নির্মাণ বন্ধ অস্বীকার করে।
এরপর দিনটা ২০১১ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি। সকালে প্রিয়া ভিয়ার থেকে মাত্র ১৫০ কিলোমিটার দূরে, সিয়েম রিপে-তে দুই দেশের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। কিন্তু এই বৈঠকে প্রিয়া ভিয়ারের কোনো কথাই উল্লেখ করা হয়নি।
ওই দিন কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী টি বান, থাইল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাভিতকে ফোন করে নির্মাণ কাজ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করে। জবাবে প্রাভিত বলেন যে, “থাইল্যান্ড যদি নির্মাণ কাজ বন্ধ করে, তাহলে কম্বোডিয়াকেও তাদের প্রবেশপথ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে।“ কিন্তু উভয় পক্ষই কাজ থামাতে অসম্মত হয়।
ফোনে কথোপকথনের সময়ে, প্রাভিত, থাই সেনাবাহিনীর কাছ থেকে খবর পান যে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত থাই বুলডোজারগুলির উপর রাইফেল এবং রকেট চালিত গ্রেনেড দিয়ে গুলি চালাচ্ছে কম্বোডিয়া।
এরপর কম্বোডিয়ার তরফ থেকে নিরাপত্তা পরিষদকে জানানো হয় যে, বিকেল তিনটের দিকে প্রায় ৩০০ থাই সৈন্য, কম্বোডিয়ার সৈন্যদের উপর আক্রমণ করে। এর কিছুক্ষণ পরেই থাইল্যান্ড জানায় যে, কম্বোডিয়ান সৈন্যরাও বিভিন্ন উন্নতমানের অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালায়। ওই সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হন। ঘর ছাড়া হন প্রায় তেরো হাজার সাধারণ মানুষ। সাত দিনের টানা লড়াইয়ের পর দুই দেশই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে।
এরপর ওই বছরের ২২শে এপ্রিল ভোরবেলা, তা মোয়ান এবং তা ক্রাবেই মন্দির এলাকায় ফের লড়াই শুরু হয়। ২২শে এপ্রিল থেকে ৫ই মে পর্যন্ত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সংঘর্ষে ৮ জন কম্বোডিয়ান এবং ৩ জন থাই সৈন্য মারা যান। এবং দুই পক্ষের কয়েক ডজন সৈন্য আহত হন।
এরপর ওই বছর, জাতিসংঘের একটি আদালত দুই দেশের সেনা প্রত্যাহারের এবং একটি অসামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয়।
এরপর সালটা ২০১৩। যখন আন্তর্জাতিক বিচারালয় নিজেদের ১৯৬২ সালের রায় পুনরায় বহাল রাখে, এবং অতিরিক্তভাবে মন্দিরের আশেপাশের ক্ষেত্র কম্বোডিয়ার বলে উল্লেখ করে।
এরপর কোন বড় যুদ্ধ কিংবা কোন সংঘর্ষ দেখা না গেলেও, থাইল্যান্ডের মধ্যে জমতে থাকে ক্ষোভ।
এরপর দিনটা ২০২৫ সালের ২৮শে মে। এমারেল্ড ট্রায়াঙ্গলে হঠাৎ করেই বিরোধ বাঁধে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে। সীমান্তে মৃত্যু হয় একজন কম্বোডিয়ান সেনার। যা দুই দেশের বিবাদের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতার মতো কাজ করে।
তবে জানতে হবে কী এই এমারেল্ড ট্রায়াঙ্গল। লাওস, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড দেশের বর্ডার মিলিয়ে একটি বিবাদমান জায়গা রয়েছে, যার নাম এমারেল্ড ট্রায়াঙ্গল অর্থাৎ পান্না ত্রিভুজ। আর এই জায়গাটিকে নিয়েই তিন দেশের মধ্যে রয়েছে মতবিরোধ। কারণ তিনটি দেশই ওই জায়গাকে নিজেদের হিসাবে দাবী করে।
এরপর ৫ই জুন, দুই দেশের মধ্যে শান্তি বজায় রাখার জন্য কথা-বার্তা হয়। ৭ই জুন, সীমান্তে আরও সৈন্য পাঠায় দুই দেশ। কম্বোডিয়ার তরফ থেকে ব্যান করে দেওয়া হয় থাইল্যান্ডের সমস্ত টেলিভিশন প্রোগ্রাম।
১৫ই জুন, দ্বন্দ মেটাতে থাইল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ ৩৭ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা, কম্বোডিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হুন সেনকে ফোন করেন। ফোনে পরিস্থিতি শান্ত করার, এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা হয়।
১৮ই জুন, সিনাওয়াত্রা এবং হুন সেনের ওই ফোন রেকর্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন হুন সেন। যা থাইল্যান্ডের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ওই ফোন কলে, সিনাওয়াত্রাকে, হুন সেনকে “কাকু” সম্বোধন করতে এবং থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীকে “বিপরীত পক্ষ” বলে তা এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলতে শোনা যায়। এছাড়া, সিনাওয়াত্রাকে আরও বলতে শোনা যায়, হুন সেন যা দাবি করবে, সিনাওয়াত্রা সেই সবকিছুর “আয়োজন” করবে।
যার পর, ১লা জুলাই, থাইল্যান্ডের আদালত প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে অপসারণের নির্দেশ দেয়। সিনাওয়াত্রা পদত্যাগ করার সময়, থাইল্যান্ডের সমস্ত জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে জানায়, “আমি শুধু বিবাদ মেটানোর জন্যই আলোচনা করেছিলাম।“
এর মধ্যে, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন ফল ও সব্জির ওপর প্রতিবন্ধকতা লাগায়। এর পাল্টা হিসাবে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ায় সরবরাহ করা বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি সীমান্তে একটি প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয় থাইল্যান্ড। এর পাল্টা হিসাবে সীমান্তে দুটি প্রবেশ দ্বার বন্ধ করে দেয় কম্বোডিয়া।
এরপর ২৩শে জুলাই, ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে একজন থাই সৈনিক নিজের ডান পা হারান। যার পর থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করার এবং কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করার কথা জানান, পাশাপাশি কম্বোডিয়া থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেন।
এরপর দিনটা ২০২৫ সালের ২৪শে জুলাই, বৃহস্পতিবার। আচমকাই ভোরের দিকে আক্রমণ হয় প্রিয়া ভিহার এলাকায়। তবে, কে প্রথম এই হামলা চালিয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। উভয় দেশই উভয় দেশের ওপর প্রথমে আক্রমণ করার অভিযোগ তুলেছে।
কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সো টেচা জানিয়েছে – সকালে স্থানীয় সাড়ে ৬টায় থাই সৈনিকরা আগের চুক্তি লঙ্ঘন করে পাশে অবস্থিত একটি হিন্দু মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসে। তার চার পাশে কাঁটা তারের বেড়া লাগিয়ে দেয়, যার ফলে ঝামেলা বাড়ে। এরপর সকাল ৭টায় ড্রোন দিয়ে অ্যাটাক করা হয়। সকাল ৮টা ৪৬ মিনিট থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। যার ফলে আত্মরক্ষার তাগিদে আক্রমণ শুরু করে কম্বোডিয়ার সৈনিকরা। পশাপাশি থাইল্যান্ড নিজেদের সীমান্তে ভারী অস্ত্র সহ F16 যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করেছে।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত জানিয়েছেন, কম্বোডিয়া সব বিষয়ে কথাবার্তার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করে, তবে, এই পরিস্থতিতে সৈন্য আক্রমণের জবাব সৈন্য আক্রমণ শক্তি দিয়ে করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের রিপোর্ট জানিয়েছে, যে সকাল সাড়ে ৭টায় হঠাৎ করেই সীমান্তে থাই সৈনিকদের ওপর চোখ রাখার জন্য কম্বোডিয়ার তরফ থেকে ড্রোন লাগানো হয়, আর RPGধারী ও BM2 রকেট লঞ্চার সহ কম্বোডিয়ান সৈনিকদের সীমান্তে মোতায়েন করা হয়। থাই সৈনিকরা কথা বলে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে চাইলে, তারা অসফল হয়। এরপর সকাল ৮টা ২০ মিনিটে কম্বোডিয়ার সৈনিকরা গুলি চালায়। যার ফলে থাইল্যান্ড পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
এই হামলার পর সীমান্তের ৮৬ গ্রাম থেকে ৪০,০০০ নাগরিককে সরানো হয়েছে। পাশাপাশি দুই দেশে থাকা, দুই দেশের নাগরিকদের দেশে ফেরার বার্তা দেওয়া হয়েছে। এই সংঘর্ষে এখনও পর্যন্ত নিহত হয়েছে সেনা সহ ১২ জন থাই নাগরিক। আহত হয়েছেন দুই সেনা সহ আরও ১৩ জন।
১১৮ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ শুধুমাত্র কি একটি মন্দিরকে কেন্দ্র করে? নাকি ভূমি দখল করাই মূল উদ্দেশ্য? উত্তর এখনও অজানা।