India Hood Decode: ধর্ষণের প্রতিবাদই কি কাল হল রাজন্যার?

Rajanya Haldar
Rajanya Haldar

২০২৩-এর ২১শে জুলাই, তৃণমূলের মঞ্চ থেকে যে তরুণীর বক্তৃতা সারা বাংলা কাঁপিয়েছিল, ঝড় তুলেছিল খবরের কাগজ, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ায়, সেই তরুণীই আজ তৃনমূলে কোণঠাসা। আর.জি. কর হোক বা কসবা ধর্ষণ, বিরোধিতাই যেন কাল হয়ে উঠল তাঁর জন্য! হতে হল সাসপেন্ডও! শুধু এখানেই শেষ নয়, ফাঁস হল তাঁর নগ্ন AI ছবিও।

গত এক বছরে ঠিক কী এমন ঘটল, যার জন্য এক ঘরে হয়ে গেল রাজন্যা (Rajanya Haldar)? দলের যে সহকর্মীদের সাথে তাঁর ওঠা বসা, বেড়ে ওঠা, আজ তাদের নামেই পুলিশের কাছে দায়ের করছেন অভিযোগ। কেনই বা তাঁকে করা হল সাসপেন্ড? আজ নিজের দলের লোকেরাই কেন তাঁর বিরুদ্ধে উগড়ে দিচ্ছে ক্ষোভ? কীভাবেই বা ফাঁস হল তাঁর AI নগ্ন ছবি? আজ এক এক করে সমস্ত তথ্য প্রকাশ করবো আমরা।

কে এই রাজন্যা? কীভাবে তৃণমূলে?

রাজন্যা হালদার। বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরে। তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় যাদবপুর বিদ্যাপীঠ থেকে। এরপর কলকাতার বিনোদিনী গার্লস হাইস্কুল থেকে পাশ করেন উচ্চ মাধ্যমিক। এরপর প্রেসিডেন্সিতে প্রথমে বাংলায় স্নাতক এবং পরে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বর্তমানে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড পাঠ্যরত।

তাঁর বাবা প্রথমে কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদের নেতা হলেও, পরে যোগ দিয়েছিলেন তৃনমূলে। সুতরাং, বাবার সূত্রে বাড়িতে বসেই রাজনীতির ময়দান সম্পর্কে ধারণা পান রাজন্যা।

সালটা ২০১৭। প্রেসিডেন্সি থেকে স্বাধীন প্রার্থী হিসাবে সিআর ইলেকশন জেতেন রাজন্যা। এর দুই বছর পর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে আবার স্বাধীন প্রার্থী হিসাবেই সিআর ইলেকশন জেতেন তিনি।

এরপর তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বর্তমান সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের নজরে পড়েন তিনি। আর সেই থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে তৃনমূলে প্রবেশ। তবে, তখনও এতটা পরিচিতি হয়নি তাঁর।

এরপর সালটা ২০২২। রাজন্যার আগের শিক্ষাঙ্গন অর্থাৎ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় তৃনমূলের ইউনিট। প্রাক্তনী হওয়ায় রাজন্যাকে সেইবার ঢুকতে দেওয়া হয়নি ক্যাম্পাসের ভিতরে। কিন্তু, দমে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না রাজন্যা। তৃনমূলের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট টপকে ভিতরে ঢোকেন তিনি, সেই ভিডিও ভাইরাল হতে সময় নেয়নি সোশ্যাল মিডিয়ায়।

এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সালটা ২০২৩-এর ২১শে জুলাই। শহীদ দিবসের মঞ্চ থেক বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ আসে তাঁর। আর সেই দিনের তাঁর গর্জন শহরের রাজপথ ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় রাজ্যের অলিতে-গলিতে। স্যাটেলাইট হোক কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া – সবেতেই ভাইরাল হয়ে যায় তাঁর ভিডিও। এরপর জনগর্জন মঞ্চ থেকে শুরু করে একের পর এক নির্বাচনী প্রচারে দেখা যায় তাঁকে।

এরপর ২০২৩ সালের ১৬ই আগস্ট। প্রথম বর্ষের এক পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন। সেই নিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তরফ থেকে বিক্ষোভ কর্মসূচী ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডেপুটেশন দেওয়া নিয়ে AIDSO-র সঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বিবাদ শুরু হয়। হয় হাতাহাতিও। অভিযোগ ওঠে সংগঠনের নেত্রী রাজন্যা হালদারের শ্লীলতাহানির। এরপর ওই ঘটনার ৩ দিন পর, ১৯শে আগস্ট, রাজন্যা হালদারকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্য়ালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি পদে নিয়োগ করা হয়।

বছর ঘুরতেই পতন!

এরপর সালটা ২০২৪। ৯ই আগস্ট, আর.জি. কর মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যায় এক নৃশংস ঘটনা। যার জেরে সারা বাংলা জুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ মিছিল, চলতে থাকে বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভেই ঘি ঢালার কাজ করে রাজন্যা। রাজন্যা ও তাঁর স্বামী প্রান্তিক চক্রবর্তী আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে “আগমনী” নামক একটি শর্ট ফিল্মের পোস্টার মুক্তি দেন, এবং ২০২৪ সালের ২রা অক্টোবর অর্থাৎ মহালয়ার দিন ছবি মুক্তির ঘোষণা করেন।

আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই দলের রোষে পড়েন তিনি। যার জেরে ২৭শে সেপ্টেম্বর, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য একটি প্রেস বিবৃতিতে জানান, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য রাজ্য তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সহ-সভাপতির পদ থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে প্রান্তিক চক্রবর্তীকে। আর যাদবপুর-ডায়মন্ডহারবার জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সহ-সভাপতির পদ থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে রাজন্যা হালদারকে। এই মুহূর্ত থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে এবং দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি তাঁদের নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত এই সাসপেনশন বজায় থাকবে।‘

এরপর দলের অনেকেই রাজন্যা এবং প্রান্তিকের বিরুদ্ধে স্পর্শকাতর বিষয়কে প্রচারে ব্যবহার করার অভিযোগ আনে। অনেকে আবার এক ধাপ এগিয়ে বলেন, আরজি করের সেন্টিমেন্টকে ক্যাশ ইন করার চেষ্টা করছেন রাজন্যা ও প্রান্তিক।

তবে, রাজন্যা ও প্রান্তিক উভয়েই ছবি মুক্তির তারিখ পিছানোর কথা জানালেও সেই ছবি এখনও পর্যন্ত মুক্তি পায়নি, এবং দল তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরায়নি।

কসবা কাণ্ড ও রাজন্যার বিস্ফোরক মন্তব্য

এরপর সালটা ২০২৫। জুন মাসের ২৫ তারিখে, কসবা আইন কলেজে ঘটে আর এক নৃশংস কাণ্ড। কলেজের মধ্যেই একজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কংগ্রেসের এক কর্মী মনোজিৎ মিশ্রের বিরুদ্ধে। আর.জি.কর কাণ্ডের এক বছর পর, কসবা কাণ্ডকে কেন্দ্র করে ফের বিরোধিতায় সরব হন সাসপেন্ড হওয়া রাজন্যা।

এবার কোন শর্ট ফিল্ম নয়, এবার অভিযোগ সরাসরি তাঁর সাথে হওয়া অন্যায় নিয়ে, অভিযোগ দলের “মনোজিৎ মিশ্রের” মতো দাদাদের নিয়ে।

ঘটনার ঠিক ৭ দিন পরে, ২রা জুলাই আর প্লাস নামক সংবাদ মাধ্যমে একটি বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেন রাজন্যা। তিনি জানান, ‘AI ব্যবহার করে তাঁর ন্যুড ছবি তৈরি করে তা জুনিয়রদের মোবাইলে ছড়িয়ে দিয়েছে দাদারা। আর এই দাদারা শাসক দলেরই ঘনিষ্ঠ।‘

তবে প্রথমে এই নিয়ে কোন পুলিশি অভিযোগ করেনি রাজন্যা। কিন্তু, ২০২৫ সালের ১২ জুলাই, এই বিষয় নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান। থানায় অভিযোগ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু সোনারপুর থানা নয়, বারুইপুর জেলা পুলিশ, ডিসি সাইবার ক্রাইম কলকাতা, ওয়েস্টবেঙ্গল সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে অভিযোগ দায়ের করেছি। আমার একটি AI বিকৃত ছবি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ছবি ঘিরে বর্তমানে নানা বক্তব্য উঠে আসছে, ওটা নাকি আমারই ছবি। আমি নাকি ধামাচাপা দিতে AI শব্দ ব্যবহার করছি। তাই ছবিটি আমার কিনা, তা তদন্ত করে বার করা হোক।’

বিজেপিতে যোগদানের সম্ভাবনা

AI ছবি সম্পর্কে থানায় অভিযোগের বিষয় নিয়ে বিজেপি নেতা সজল ঘোষের সাথে কথা হয় রাজন্যা হালদারের, এমনটাই দাবি করেছেন বিজেপি নেতা।

আর এই কথোপকথন সম্পর্কে স্বীকারও করেছেন রাজন্যা। তবে, দল পরিবর্তন কিংবা বিজেপিতে যোগদান নিয়ে কোণ ধরনের কথা শোনা যায়নি তাদের মুখে।

অন্যদিকে, রাজ্য রাজনীতিতে জল্পনা রাজন্যা ও প্রান্তিক অগ্নিমিত্রা পলের সঙ্গে দেখা করেছে। পাশাপাশি অভিযোগ তাদের বিজেপির তরফ থেকে পেট্রোল পাম্প ও টাকা দেওয়া হয়েছে! তবে এই জল্পনাও উড়িয়ে দিয়ে নিজেকে দলের কর্মী হিসাবে জানিয়েছেন রাজন্যা হালদার।

মনোজিতের সাথে প্রান্তিকের যোগ!

এর মধ্যেই অন্যদিকে রাজন্যার স্বামী প্রান্তিককে নিয়ে উঠেছে বড়সড় অভিযোগ। তাঁর সাথে মনোজিত মিশ্রের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক – এমনই গুরুতর অভিযোগ এনেছেন সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের প্রাক্তন একজন ছাত্র এবং আইনজীবী তিতাস মান্না।

এই তিতাস মান্না মনোজিত মিশ্রের সহপাঠী ছিলেন, এবং কসবা ল কলেজ ঘটনায় তিনি মনোজিত সম্পর্কেও বিস্ফোরক তথ্য সামনে এনেছিলেন।

আইনজীবী তিতাস মান্না এবার জানিয়েছেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, প্রান্তিক চক্রবর্তীর নেতৃত্বে টিএমসিপির লিগ্যাল সেল তৈরি হয়। আর এই প্রান্তিকই, মনোজিতকে লিগ্যাল সেলের কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। যা নিয়ে আইনজীবীদের একাংশ আপত্তি তুললেও, প্রকাশ্যে কেউ কিছু জানায়নি। লিগাল সেল তৈরী করে প্রান্তিক অনেক আগেই ,মনোজিৎ মিশ্রকে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন।

তবে, এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রান্তিক চক্রবর্তী। তিনি জানিয়েছেন, আগেও মনোজিত মিশ্রের সাথে অনেক নেতা নেত্রীর ছবি দেখা গিয়েছে। কিন্তু, এই বিষয়ে দল থেকে জানিয়েছে ছবি দিয়ে রাজনীতি হয় না, কিন্তু আমার ব্যাপারে ছবি তুলেই রাজনীতি করা হচ্ছে।

রাজন্যার অভিযোগ নিয়ে তৃণমূলের মহিলাদের মন্তব্য

রাজন্যার এই AI মন্তব্য প্রসঙ্গে বিধায়ক লাভলী মৈত্র প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘যদি এতই সমস্যা ছিল, তাহলে এতদিন চুপ ছিলেন কেন? এখন হঠাৎ কেন এসব বলছেন? হঠাৎ করে একদিন মনে হল আর মিডিয়ার সামনে বাইট দিতে বসে গেলাম – এই ব্যাপারটা পুরোপুরি অবাস্তব।‘ এছাড়া, রাজন্যার ওই কর্মকাণ্ডের পিছনে বিজেপি মদত থাকার ইঙ্গিত দেন বিধায়ক।

রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মেয়ে প্রিয়দর্শিনী হাকিম বলেন, ‘রাজন্যা বুঝতে পেরেছে তৃণমূলে আগে কাজ করতে হবে তারপর টিকিট। তাই আর ধৈর্য রাখতে পারেনি। শুধু ফুটেজ খাওয়ার চেষ্টা এখন। ২০২৬-এ বিজেপির টিকিট পাবে। আমিও একজন মহিলা। দলের কোনও সহকর্মীদের থেকে কোনেদিন কোনও বাজে ইঙ্গিত পাইনি।’

এছাড়াও, রাজন্যার AI মন্তব্য নিয়ে তাঁর বিরোধিতা করেছেন কাউন্সিলর জুঁই বিশ্বাস ও ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের কন্যা প্রিয়দর্শিনী ঘোষও।

সর্বশেষ পাওয়া আপডেট অনুযায়ী, রাজন্যাকে গত ১৫ই জুলাই সোনারপুর থানায় ডেকে এই ঘটনা সম্পর্কে ঘণ্টাখানেক জেরা করা হয়। যেখানে তাঁকে একাধিক প্রশ্ন করার পাশাপাশি তাঁর থেকে ছবির সূত্র এবং URL লিঙ্ক চাওয়া হয়েছে।

Leave a Comment