India Hood Decode: ভোট চুরি নাকি ভোট বাঁচানো, ফাঁস দুমুখো রাজনীতি!

Mamata Banerjee And Rahul Gandhi On SIR
Mamata Banerjee And Rahul Gandhi On SIR

কখনও “ভোট চুরি“! কখনও বা “ভূত ভোটার!” ২০২৪-এর পর থেকে এমনই অভিযোগ করে আসছে বিজেপি বিরোধী দলগুলি। বিভিন্ন সময় মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়েও তোপ দেগেছেন রাহুল গান্ধী-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা (Mamata Banerjee And Rahul Gandhi on SIR)।

কিন্তু, ২০২৫ সালে নির্বাচন কমিশন ভুয়ো ভোটার ধরতে SIR চালু করলে এবার তারই বিরোধিতা করতে থাকে বিরোধীরা।

একদিকে, যারা বলছেন ভুতুড়ে ভোটার রয়েছে, অন্যদিকে তারাই বিরোধিতা করছে SIR-এর – কেন এই দুমুখো দাবী বিরোধীদের? ভুয়ো ভোটার বাদ গেলে কাদের ক্ষতি হবে, বিজেপি, নাকি কংগ্রেস-তৃণমূলের মতো দলগুলির? এই দুমুখো রাজনীতির আসল সত্যতা আজ ডিকোড করবে India Hood।

মমতা ও রাহুলের বক্তব্য! | Mamata Banerjee And Rahul Gandhi on SIR

২০২৫ সালের ৬ই জানুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন। যেখানে প্রায় সাত লক্ষ ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয়, এবং যুক্ত করা হয় ১০ লক্ষ ৭৮ হাজার নতুন ভোটারের নাম।

এরপর থেকেই দফায় দফায় ‘ভূত ভোটারের’ অভিযোগ তুলতে শুরু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গা থেকে পাওয়া যায় কয়েক হাজার ভূতুড়ে ভোটার সহ বেশ কিছু বাংলাদেশির নাম।

প্রথম অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী জানান, দুই ভিন্ন রাজ্যের ভোটারের একই এপিক নম্বর রয়েছে। যার ফলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্ক্রুটিনি করার পরামর্শ দেন তিনি।

এই বিষয়ে কমিশন স্পষ্ট জানায় যে, কিছু ভোটারের এপিক নম্বর একই হতে পারে। তবে তাঁদের অন্যান্য বিবরণ, যেমন জন্মসংক্রান্ত তথ্য, বিধানসভা কেন্দ্র, এবং ভোটকেন্দ্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে যাতে এই নম্বর আলাদা হয় তারও সম্ভাবনার কথা জানান তারা।

এরপর রাহুল গান্ধী, ৭ই আগস্ট INDIA জোটের নৈশভোজের সাক্ষাৎকারের সময় নির্বাচন কমিশনের একাধিক গাফিলতির উদাহরণ তুলে ধরেন।

প্রথম অভিযোগে তিনি জানান, বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মহাদেবপুরা বিধানসভায় এক লক্ষেরও বেশি ভোট চুরি হয়েছে। ওই এলাকায় ১৫০ বর্গফুটের একচিলতে একটি ঘরে ৮০ জন ভোটারের নাম নথিভুক্ত রয়েছে। যারা বিজেপির ভোটার।

সত্যতা যাচাই – সেই সত্যতা যাচাই করতে গেলে, ওই বাড়ির মালিক জয়রাম রেড্ডি এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। এবং জানান যে তিনি কংগ্রেসপন্থী। পাশাপাশি তিনি জানান, আমার এই ঘরে বিভিন্ন সময়ে একাধিক অভিবাসী শ্রমিক বিভিন্ন সময়ে ভাড়া থেকেছেন। সেই সময়ে ভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী তাদের ভোটার আইডি কার্ড হত। হয়তো তারা চলে যাওয়ার পরেও এখনও ওই একই ঠিকানার কার্ড ব্যবহার করেন। আর এই ভোটার কার্ড বিভিন্ন ‘এজেন্টরা’ বিভিন্ন অর্থের বিনিময়ে যে কাউকে, এমনকি পাকিস্তানের কাউকে সরবরাহ করেন। তবে, ওই মালিক আরও জানান, এই কার্ড তারা ভোট দেওয়ার জন্য কখনোই তৈরি করতো না, শুধুমাত্র ঠিকানার প্রমাণের জন্য তৈরি করতো।

দ্বিতীয় অভিযোগে, রাহুল গান্ধী বলেন শাকুন রানী নামের ৭০ বছর বয়সী এক মহিলার কথা, যিনি প্রথমবার ভোটার হয়েছিলেন, এবং ফর্ম 6 ব্যবহার করে দুবার ভোটার তালিকায় নাম তুলেছিলেন। এবং ভোটও দিয়েছেন দুবার, কারণ পোলিং অফিসার তাঁর নামের পাশে দুবার টিক দিয়েছেন। এটি লুকানোর জন্য, সিসিটিভি ডেটাও দেওয়া হচ্ছে না। এর পাশাপাশি রাহুল গান্ধী বলেন, হাজার হাজার মানুষ আছেন যারা ফর্ম 6 ব্যবহার করে ভোটার তালিকায় ২-৩ বার নিজেদের নাম রেখেছেন।

সত্যতা যাচাই – কমিশন এই অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, যে ডকুমেন্ট রাহুল গান্ধী দিয়েছেন তা পোলিং অফিসারের দ্বারা টিক দেওয়া নয়। তিনি যেন হলফনামা দিয়ে সঠিক ডকুমেন্ট জমা দেন, নাহলে তাঁর এই দাবি ভিত্তিহীন।

তৃতীয় অভিযোগে, রাহুল গান্ধী, আদিত্য শ্রীবাস্তব নামের একজনের পরিচয় দেন, যিনি একই (EPIC নম্বর – FPP6437040 স্ক্রিনে এটা দেখাতে হবে) EPIC নম্বর সহ চারটি লোকসভা কেন্দ্র, উত্তরপ্রদেশের লখনউ ইস্ট, মহারাষ্ট্রের যোগেশ্বরী ইস্ট, এবং কর্ণাটকের মহাদেবপুরা এবং ব্যাঙ্গালোরে নথিভুক্ত আছেন।

সত্যতা যাচাই – আদিত্য শ্রীবাস্তব নামক ওই ব্যাক্তিকে যখন এই বিষয়ে কল করে ইন্ডিয়া টিভির একজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন, তিনি জানান, তিনি মূলত উত্তরপ্রদেশের লখনউয়ের বাসিন্দা, যিনি সেখানে ২০০৯ সালে নিজের প্রথম ভোটার কার্ড তৈরি করেন। এরপর ২০১৭-১৮ সালে তিনি কর্মসূত্রে মুম্বাইয়ে এসে, অনলাইনে আবেদন করে নিজের ভোটার আইডি কার্ডে ঠিকানা পরিবর্তন করে মুম্বাই যোগ করেন। এরপর ২০২১ সালে বেঙ্গালুরুতে স্থানান্তর হলে, নির্বাচন কমিশনের নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে কার্ডে মুম্বাইয়ের পরিবর্তে ব্যাঙ্গালোরের ঠিকানা যোগ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরানো তালিকায় তাঁর নাম কেন রয়ে গেল এই বিষয়ে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি। এরপর উত্তরপ্রদেশের মুখ নির্বাচনী আধিকারিক সহ একাধিক মিডিয়ার অনুসন্ধানে উঠে আসে, বর্তমানে শুধু কর্ণাটকের একটি লোকসভা কেন্দ্রে নাম রয়েছে ওই ভোটারের। অন্য কোথাও তাঁর নাম সার্চ করলে নো রেজাল্ট ফাউন্ড দেখাচ্ছে।

অন্যান্য অভিযোগে, বিহারের খসড়া ভোটার তালিকায় প্রায় ৩ লক্ষ ভোটারের বাড়ির নম্বর ০।

সত্যতা যাচাই – এর উত্তরে নির্বাচন কমিশনের এক আধিকারিক জানান, “ফর্মে অনেকে বাড়ির নম্বর উল্লেখ করেনি। তাই অনির্ধারিত বাড়ির ঠিকানার পাশে ০ বসানো থাকছে। আমরা বিষয়টি সংশোধন করার চেষ্টা করছি।”

অন্যান্য অভিযোগে, এক কংগ্রেস মুখপাত্র সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ৫৭ বছর বয়সী রামকমল দাস, যার ৪৫জন সন্তান। যার জ্যেষ্ঠ সন্তানের বয়স ৭২, আর ছোট ছেলের বয়স ২৭ বছর।

সত্যতা যাচাই – ওই ব্যাক্তির সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, ওই রামকমল দাস আদতে বারাণসীর রামজানকি মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা এবং একজন মহারাজ, যিনি অবিবাহিত। সনাতন ধর্মের ঐতিহ্য অনুযায়ী, যারা ব্রহ্মচর্য নেন, তারা নিজেদের পিতা মাতার নাম ত্যাগ করে গুরুর নামকেই নিজেদের অভিভাবকের নাম হিসাবে গ্রহণ করেন। যার ফলে ভোটার কার্ডেও তারা পিতার নামের জায়গায় ওই মহারাজের নাম দিয়েছেন।

কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লোকসভা সহ বেশ কয়েকটি নির্বাচনে কমিশনের কারচুপির একাধিক অভিযোগ তুলেছেন রাহুল গান্ধী সহ অন্যান্য বিরোধীরা। তবে, নির্বাচন কমিশন সাফ জানিয়েছে, রাহুল গান্ধী বা অন্যান্য অভিযোগকারীরা হয় হলফনামার মাধ্যমে নিজেদের অভিযোগ পেশ করুক, অথবা ভিত্তিহীন অভিযোগ করার দায় স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চান! সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে রাহুল অসম্মান করতে চাইছেন বলে দাবি করেছে কমিশন।

এবার আসি SIR প্রসঙ্গে

২০২৫ সালের ২৪শে জুন বিহারে SIR চালু হতেই, ধরা পড়ে প্রায় ৬৫ লক্ষ ভুয়ো ভোটারের নাম। যার পর দেশ জুড়ে হাহাকার শুরু করে দেয় বিজেপি বাদ দিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি। মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টেও। বিরোধীরা দাবি করেন, ন্যায়সঙ্গতভাবে বাদ দেওয়া হয়নি এই নাম। বিজেপি এই SIR নিয়ে বলে, ‘সাফাই’ হচ্ছে। কংগ্রেস বলে, ‘জবাই হচ্ছে গণতন্ত্র’, আর বাংলার শাসকদল তৃণমূলের বক্তব্য, ‘ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র’। এই নিয়ে দফায় দফায় বিরোধীরা বিক্ষোভ দেখান লোকসভা এবং রাজ্যসভার বাইরে।

SIR সাধারণ অর্থে এক ধরনের ভোটার তালিকা সংশোধন। কিন্তু এটির গুরুত্ব কি? কেন এটি নিয়ে এত বিতর্ক, এই বিষয়ে বিশদে জানতে হলে ক্লিক করুন আই বাটনে। এই নিয়ে আমাদের একটি বিস্তারিত ভিডিও রয়েছে।

এরপর সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে নির্বাচন কমিশন জানায়, “নোটিস না-দিয়ে কোনও ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হবে না বিহারে। সেই নোটিশে উল্লেখ থাকবে, কী কারণে ওই নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিজের দাবির সপক্ষে যে কেউ প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে পারবেন।

এরপর ২৮শে জুলাই, পশ্চিমবঙ্গেও SIR চালু করার জন্য পদক্ষেপ নেয় নির্বাচন কমিশন। সেই উদ্দেশ্যে শেষবার অর্থাৎ ২০০২ সালে, পশ্চিমবঙ্গে করা সংশোধনের তালিকা প্রকাশ করা হয় কমিশনের তরফে।

সুপ্রিম কোর্ট কি বলছে?

১৩ই আগস্ট বিচারপতি সূর্য কান্ত জানান, কমিশন ঠিকই বলছে, আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ হতে পারে না। সেক্ষেত্রে নাগরিকত্ব আলাদা করে যাচাই করতে হবে।

এরপর ১৪ই আগস্ট বিচারপতি বাগচী বলেন, ‘‘আধার কার্ড স্থায়ী বসবাসের প্রমাণপত্র হিসাবে এবং পরিচয়পত্র হিসাবে আইনত স্বীকৃত একটি নথি। কোনও রকম সমস্যা হলে পরিচয় এবং বাসস্থানের প্রমাণ হিসাবে আধার কার্ড নিয়ে নির্বাচনী আধিকারিকদের দ্বারস্থ হতে পারবেন নাগরিকেরা।“ গোটা প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ভাবে করার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

২২ শে আগস্ট এই মামলার পরবর্তী শুনানি রয়েছে।

যে প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা!

প্রথমত, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২৫ সালের শুরু থেকেই মে মাস অবধি ভূত ভোটার, ভুয়ো ভোটারের তরজা উস্কে দিয়েছেন, তিনিই জুন মাস থেকে ভোটার তালিকা সংশোধনের বিরোধিতা করা শুরু করেছেন কেন?

দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশন ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকে ভিত্তি করে SIR সম্পাদন করছে। কিন্তু, তৃণমূল নেতৃত্বরা এই ক্ষেত্রে ২০২৪ সালের ভোটার তালিকাকেও অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছে। আবার অন্যদিকে, তারাই ২০২৪ সালের ভোটার তালিকাতেই একাধিক ভূত ভোটার থাকার অভিযোগ তুলেছেন। ফলত তাদের দুমুখো দাবীর উত্তর এখনও অধরা!

তৃতীয়ত, রাহুল গান্ধীর দেওয়া পরিসংখ্যানে শুধুমাত্র বিজেপির জেতা অঞ্চলগুলি নিয়ে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে কেন? কেন নেই কংগ্রেসের জেতা কোন আসনের পরিসংখ্যান?

চতুর্থত, কেনই বা শুধু প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ডাক দিচ্ছেন তিনি? কেন আওয়াজ তুলছেন না পুনরায় নির্বাচনের? কেনই বা ভুয়ো ভোটার দিতে SIR সমর্থন করছেন না?

পঞ্চমত, যদি মমতা এবং রাহুলের ভুয়ো ভোটার তত্বকে সঠিক মেনে SIR এর কথা ধরা হয়, একদিক থেকে এই প্রক্রিয়া তো মমতা এবং রাহুলের দাবীর সাথে যুতসই! সেক্ষেত্রে SIR নিয়ে বিরোধিতার কারণ কি শুধু নির্বাচন কমিশনের চাওয়া ১১টি ডকুমেন্টস? উত্তর এখনও অধরা!

ষষ্ঠত, তৃণমূলের বিরুদ্ধে বহুবার বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ব্যবহার করে ভোট জেতার অভিযোগ তুলেছে বিজেপিও। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন যদি SIR হয়, এবং ভুয়ো ভোটার বাদ যায়, তাহলে কোন দলের ক্ষতি হবে?

বিরোধীদের এই দুমুখো প্রতিবাদ সম্পর্কে আপনার কি মতামত? অবশ্যই জানান কমেন্ট বক্সে। India Hood-এর পরবর্তী ডিকোড জানতে সাবস্ক্রাইব করুন India Hood।

Leave a Comment