৫০ বছর ধরে গর্তহীন ভারতের এই রাস্তা, তাও কোন কন্ট্রাক্ট পায়নি রাস্তা নির্মাণকারী সংস্থা

Jangli Maharaj Road
Jangli Maharaj Road

যে দেশে বর্ষাকাল আসা মানেই জলের তলায় ডুবে যায় সাধারণ রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে জাতীয় সড়ক। যে দেশে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে রাজধানী দিল্লি, মুম্বাই থেকে শুরু করে চেন্নাই – সর্বত্র একই ছবি পরিলক্ষিত হয়, সেখানেই দেশের মধ্যেই রয়েছে এমন একটি রাস্তা, যার বয়স প্রায় ৫০ বছর হলেও, হয়নি কোন গর্ত, কিংবা বড়সড় মেরামত! আমাদের দেশের ২.৫ কিলোমিটার এই রাস্তাকে দুর্নীতিমুক্ত, উচ্চমানের পরিকাঠামোর একটি মানদণ্ড হিসাবে ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু জানলে অবাক হবেন, যে সংস্থা এই রাস্তা তৈরি করেছে, সে সংস্থাকে গত ৫০ বছরে দেওয়া হয়নি দেশের আর অন্য কোন রাস্তা তৈরির কন্ট্রাক্ট।

আমরা কথা বলছি…

আমরা কথা বলছি পুনে শহরের জংলি মহারাজ রোড (Jangli Maharaj Road) অর্থাৎ জেএম রোডের কথা। ১৯৭৬ সালে পুনের এই ব্যস্ততম রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু, এর সূত্রপাত হয় ১৯৭৩ সালে। যখন ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় পুনের একাধিক রাস্তাঘাট। তৎকালীন পুনে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র এবং স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে আসীন ছিলেন ২১ বছর বয়সী শ্রীকান্ত শিরোলে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “প্রতি বছর ভারী বৃষ্টিপাতে মুম্বাইয়ের রাস্তাঘাটের এমন অবস্থা তো হয় না, তাহলে পুনেতে এই সমস্যা হচ্ছে কেন?” পাশাপাশি তিনি সমাধান খুঁজতে শুরু করেন। এরপর পুনের ইঞ্জিনিয়াররা খোঁজ পান মুম্বাইয়ের পার্সি মালিকানাধীন একটি সংস্থা, রিকন্ডো-র। যারা একটি উন্নত “হট মিক্স” প্রযুক্তি ব্যবহার করে দীর্ঘস্থায়ী রাস্তা তৈরি করে। মুম্বাইয়ের রাস্তাঘাটের সমস্যা মেটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ওই কর্পোরেটর ব্যক্তিগতভাবে কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেন এবং জেএম রোডের প্রকল্পটি তাদের নেওয়ার জন্য রাজি করান।

কোনও পাবলিক টেন্ডার জারি না করেই সরাসরি কাজটি রিকন্ডো সংস্থাকে দেওয়ার জন্য পুনে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সবাইকে রাজী করায় শ্রীকান্ত। কিন্তু, এর বিনিময়ে রিকন্ডো একটি লিখিত গ্যারান্টি দেয়। সেই গ্যারান্টি অনুযায়ী, রাস্তাটিতে আগামী ১০ বছর কোন গর্ত হবে না, এবং কোনও ক্ষতি হলে তা বিনামূল্যে মেরামত করা হবে। ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি, আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় জেএম রোডের। এবং চুক্তি অনুযায়ী ১৯৮৫ সালে চুক্তির দশ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও, রাস্তাটিতে সামান্য একটা চিড় পর্যন্ত ধরেনি। সেই সময়ে ২.৫ কিমি এই রাস্তা নির্মাণ করতে ১৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল।

জেএম রোডের দীর্ঘ স্থায়িত্বের পেছনে রয়েছে সূক্ষ্ম নকশা, সর্বোত্তম উপকরণের ব্যবহার এবং “হট মিক্স” প্রযুক্তির সমন্বয়, যা তখন ভারতে সবেমাত্র প্রবেশ করেছিল। এতে বিটুমিনের সাথে অ্যাগ্রিগেটগুলিকে গরম করা হত এবং মেশানো হত, তারপর গরম অবস্থায় অ্যাসফল্ট দিয়ে কম্প্যাক্ট করা হত, এবং একটি মসৃণ, দীর্ঘস্থায়ী পিচ তৈরি হত।

কিন্তু সব থেকে অবাক করার মতো বিষয় হল। এই সফলতা সত্ত্বেও, রেকন্ডো সংস্থাকে পুনের তরফ থেকে আর আর কোনও প্রকল্প দেওয়া হয়নি। শিরোলে, যার এই রাস্তা তৈরির পিছনে বিরাট অবদান ছিল, তিনি স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন, রাস্তা টেকসই হলে দুর্নীতি কম হয়ে যায়। ফলে পরবর্তীতে কেউ আর এই রকম রাস্তা করেনি। অন্যদিকে, বছরের পর বছর ধরে সফলতা পেলেও, দুই ভাই আলাদা হয়ে যায়, এবং রিকন্ডো ডেভেলপারস অ্যান্ড কন্ট্রাক্টরস প্রাইভেট লিমিটেড বন্ধ হয়ে যায়।

বর্তমানে আমরা এমন সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে উদ্বোধনের কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েক কোটি টাকার কন্ট্রাক্টে নির্মিত রাস্তা-ব্রিজ ভেঙে পড়ার খবর দেখা যায় সর্বত্র। সম্প্রতি, কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গডকরি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আগামী দুই বছরের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন মহাসড়কগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও উন্নত হবে।

তবে, সম্প্রতি ভারতের জাতীয় মহাসড়ক কর্তৃপক্ষ (NHAI) দ্বারা নির্মাণ হওয়া দিল্লি-মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়েতেও একাধিক গর্ত চোখে পড়েছে। ভাবুন যদি রাজ্যের মহাসড়কের এই অবস্থা হয়, তাহলে দেশের অলিতে গলিতে থাকা রাস্তাগুলির কী অবস্থা হতে পারে।

জেএম রোডের ইতিহাস

শিবাজিনগরে অবস্থিত জঙ্গলি মহারাজ মন্দির এবং ডেকান জিমখানার মধ্যে সংযোগকারী রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে জঙ্গলি মহারাজ নামক একজন সাধুর নামে। যিনি বিশ্বাত্মক গুরুদেব নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৮১৮ সালে বরোদায় (বর্তমানে গুজরাটের ভদোদরা হিসাবে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেন। আক্কালকোটের স্বামী সমর্থের শিষ্য ছিলেন তিনি। উচ্চতায় সাত ফুটেরও বেশি লম্বা এই সাধু পরবর্তীতে আধ্যাত্মিকতার জগতে প্রবেশ করেন, এবং পুনের শিবাজিনগরের ঘন ভাম্বুরদে জঙ্গলে নিজের ধ্যান শুরু করেন। সেখানি তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন, এবং তখন থেকে তাঁর নামে হয় জঙ্গলি মহারাজ। এবং ওখানেই এখন ওই রাস্তাটি অবস্থিত।

রাস্তাটি সাংস্কৃতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৮ম শতাব্দীর তিনটি পাথর কেটে তৈরি গুহা মন্দির, যা পাতালেশ্বর গুহা মন্দির নামে পরিচিত, এবং জঙ্গলি মহারাজের সমাধি মন্দিরটিও এই রাস্তায় অবস্থিত, যা পুনের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র।

পুনে মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের অতিরিক্ত কমিশনার ওমপ্রকাশ দিলওয়াতে জানিয়েছেন, “প্রধান রাস্তাটি অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে। ২০১০ সালে, এর ওপর একবার আলকাতরা লেপন করা হয়েছিল, কিন্তু কোনও গর্ত দেখা যায়নি। এরপর ২০১৪ সালে, পুনের স্মার্ট সিটি মিশনের অংশ হিসেবে জেএম রোডের আরও একবার সংস্কার করা হয়েছিল। এরপর ২০২২-২৩ সালেও পিএমসি আরবান স্ট্রিট প্রকল্পের অধীনে জেএম রোডে ফুটপাথ নির্মাণ এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়।

Leave a Comment