মমতার মাথায় বাজ! এই বিল কিভাবে বদলে দেবে বাংলাকে

130th Amendment Bill
130th Amendment Bill

CAA, ওয়াকফ বিলের পর ফের একবার সরগরম হয়ে উঠল লোকসভা! কারণ একটাই – কেন্দ্রের প্রস্তাবিত ১৩০ তম সংশোধনী বিল (130th Amendment Bill)। এমন একটি বিল যার কারণে রাতারাতি পদ হারাতে পারেন অভিষেক থেকে ফিরহাদ, মমতা থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদীও!

কিন্তু, কী এমন আছে এই বিলে যার ফলে বিল পেশ করতে না করতেই ধুন্ধুমার হয়ে উঠল লোকসভা! বিল ছিঁড়ে, ছুঁড়ে দেওয়া হল অমিত শাহের দিকে? এই বিল কি সত্যিই গণতন্ত্র বিরোধী? আজ এক এক করে সমস্ত তথ্য ডিকোড করবে India Hood।

কী এই ১৩০তম সংশোধনী বিল?

দিনটা ২০২৫ সালের ২০ আগস্ট। লোকসভায় এক এক করে মোট তিনটি বিল পেশ করেন  কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তার মধ্যে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকার সংশোধনী বিল, দ্বিতীয়টি জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন সংশোধনী বিল, এবং তৃতীয় এবং যেটি নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে, সেটি হল ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল।

১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিলের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৫, ১৬৪, ২৩৯AA পরিবর্তন করার দাবী তোলা হয়।

  • ভারতীয় সংবিধানের ৭৫ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নিয়োগ এবং তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে ব্যখ্যা করে।
  • ১৬৪ নম্বর অনুচ্ছেদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে।
  • এবং, ২৩৯AA অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যা করে দিল্লি এবং অন্যান্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ সম্পর্কে।

১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিলের মাধ্যমে এই তিনটি আইনকে নতুন করে সংশোধন করা হয়েছে। বলা হয়েছে – “যদি প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য যে কোনও কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের মন্ত্রীকে ৫ বছর বা তার বেশি মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়, এবং তাঁকে টানা ৩০ দিন জেল হেফাজতে রাখা হয়, তাহলে ৩১তম দিনে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে! তবে সংশোধনে এও বলা হয়েছে, যদি পদ থেকে হঠানোর পরেও কোন মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেল থেকে মুক্তি পায়, তবে তাঁকে পুনরায় ওই পদে বসানো যাবে

লোকসভায় অমিত শাহ বিল পেশ করে জানান, ‘কোন ব্যাক্তি জেল থেকে দেশ শাসন করতে পারেন না, সংবিধান যারা তৈরি করেছিলেন, তাঁরা কোনদিন কল্পনা করেননি যে গুরুতর মামলায় কেউ গ্রেফতার হওয়ার পরেও নিজের পদে বহাল থাকবেন। তাই এই আইনটিকে পুনরায় বিবেচনা করা হোক।‘

শুধু তাই নয়, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, গ্রেফতার হলেই ৫০ ঘণ্টার মধ্যে শাস্তির মুখে পড়তে হয় সরকারি কর্মচারীদের, এমনকি হারাতে পারেন চাকরিও। সেখানে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম আলাদা কেন?

আগেও উঠেছে এই বিলের কথা!

তবে এই প্রথম নয়, ১৯৯৯ সালেও বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে ভারতের নীতি আয়োগ এই একই প্রস্তাবনার কথা জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, যদি কোর্ট কোন বিধায়ক বা মন্ত্রীকে দোষী পায়, তাহলে সম্পূর্ণ শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত, কিংবা জেল থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত তাঁকে ওই পদের জন্য অযোগ্য মানা হবে। তবে এর কোন সময়সীমা ধার্য করা হয়নি।

এরপর ২০১৪ সালেও মোদী ক্ষমতায় আসার পর ভারতের নীতি আয়োগ একই প্রস্তাব তোলে।

কিন্তু, এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট ৫ বিচারপতির একটি বেঞ্চ গঠন করে, এবং জানিয়ে দেয়, ‘অযোগ্যতা নিয়ে কোনও আইন বানানোর ক্ষমতা সংসদের নেই, এবং সুপ্রিম কোর্টও এই নিয়ে কোনও আইন বানাতে অস্বীকার করে।‘

তবে, সুপ্রিম কোর্ট এও জানিয়েছিল, ‘সংসদের এমন কিছু কঠোর আইন বানানো উচিত, যাতে পার্টি গুরুতর এবং জঘন্য অপরাধমূলক অভিযোগ থাকা ব্যাক্তির সদ্যসপদ শেষ করে দেন। পাশাপাশি এই সমস্ত ব্যাক্তিদের যেন নির্বাচনে লড়ার জন্য টিকিটও না দেয়।‘

বিরোধীদের বক্তব্যঃ

লোকসভায় এই বিল পেশ হতেই অধিবেশন কক্ষের অন্দরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন বিরোধী সাংসদেরা। হট্টগোলের মাঝেই বিরোধী সাংসদেরা বিলের কাগজ ছিঁড়ে ছুঁড়ে দেন অমিত শাহের দিকে। এরপর বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। বিরোধীদের বিক্ষোভের জেরে মুলতুবি হয়ে যায় লোকসভার অধিবেশন।

১। কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেন, “এটা ভ্রষ্টাচার। কাল যে কেউ মুখ্যমন্ত্রীর নামে যে কোন মামলা দায়ের করে, তাঁকে বিনা দোষে দোষী সাব্যস্ত করে ৩০ দিনের জন্য গ্রেফতার করে তাঁর মন্ত্রীত্ব কেড়ে নেবেন। এটি সম্পূর্ণরূপে সংবিধান বিরোধী।“

বিভিন্ন মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে মিথ্যা মামলা আরোপ করার অভিযোগ আগেও দেখা গিয়েছে বলে জানান আপ নেতা অনুরাগ ডাণ্ডা। এমনকি তিনি মনে করেন, “এই নীতি ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় সরকার যে কোন রাজ্যের সম্পূর্ণ সরকার ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত করতে পারে।“

২। AIMIM সাংসদ আসাউদ্দিন অয়েইসি এই বিলের বিরোধিতা করে জানান, “বিলে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করবেন। কিন্তু, সংবিধান বলছে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পরামর্শ মেনে কাজ করবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে কে গ্রেফতার করবে?“

৩। এই বিষয়ে তৃণমূল নেত্রী মহুয়া মৈত্র জানান, “রাজ্যের ৮-৯ কোটি মানুষ একজন মুখ্যমন্ত্রীকে নির্বাচন করেন। আর অন্যদিকে বিজেপি কেন্দ্রীয় সংস্থা ED/CBI-কে ব্যবহার করে ১ শতাংশ অনুমানের ভিত্তিতে সেই মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করবে, এবং ৩১ দিনের মাথায় তাঁকে পদত্যাগ করাবে। তাহলে তো বিচার বিভাগের কোন দরকার নেই।“

৪। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “নতুন সংশোধন অনুযায়ী, আমাকে গ্রেফতার করলে আমি আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করার সময়টুকুও পাবো না। তাহলে তো ভারতবর্ষে কোন কোর্টের প্রয়োজন নেই।“ এছাড়া তিনি আরও বলেন, “কেন্দ্রের অভিপ্রায় ঠিক থাকলে আমরা সই করব, ৩০দিন নয় ১৫ দিন করুক সময়সীমা। তাতে সমর্থন করবো, কিন্তু নিয়মে রাখতে হবে, যদি ১৫ দিনে আমার অপরাধ প্রমাণিত না হয়, তাহলে তদন্তে যে অফিসার যুক্ত রয়েছে, তাঁকে তাঁর দ্বিগুণ সময় জেলে থাকতে হবে।“

৫। আরেক কংগ্রেস সাংসদ মনীশ তিওয়ারি জানিয়েছেন, ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রত্যেকেই নির্দোষ। কিন্তু, বিলের নতুন সংশোধন অনুযায়ী, কেউ ৩০ দিন হেফাজতে থাকলেই তাঁকে দোষী মেনে পদ থেকে সরানো হচ্ছে।

কেন এই আইন প্রয়োজন?

ভারতের ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা রয়েছে, যা জানলে আপনারও মনে হতে পারে এই আইনের সত্যিই সংশোধন প্রয়োজন!

২০২৪ সালের ২১শে মার্চ, দিল্লিতে আবগারি দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। জেলে গেলেও তিনি ইস্তফা দেননি। এরপর ২০২৪ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ৬ মাস পরে, সুপ্রিম কোর্টে জামিন পান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এরপর ১৭ই সেপ্টেম্বর তিনি নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন। অর্থাৎ, জেল থেকেই তিনি ৬ মাস মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার সামলান!

একইরকমভাবে, ২০২৩ সালের ১৪ই জুন, অর্থের বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে তামিলনাড়ুর পরিবহনমন্ত্রী সেন্থিল বালাজিকে গ্রেফতার করে ED। এর প্রায় ৮ মাস পর, ২০২৪ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি জেলে থাকার সময় নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। এরপর ওই বছরের ২৬শে সেপ্টেম্বর তাঁকে সুপ্রিম কোর্টে জামিন দেওয়া হলে, ২৯শে সেপ্টেম্বর তাঁকে মন্ত্রী পদে বহাল করা হয়। এরপর ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে, ইডি সুপ্রিম কোর্টে বালাজির জামিন বন্ধ করার আবেদন জানায়। যারপর সুপ্রিম কোর্ট, বালাজিকে দুটো বিকল্প দেয় – হয় তিনি জামিনে থাকুন, নাহলে মন্ত্রী পদ ছেড়ে দিক। এরপর, বালাজি মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জামিনের বিকল্প বেছে নেন।

এবার আসি পশ্চিমবঙ্গে। ২০১৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর, চিটফান্ড কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হওয়ার পর রাজ্যের ক্রীড়া ও পরিবহনমন্ত্রী পদে বহাল ছিলেন মদন মিত্র। ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর গ্রেফতার হওয়ার পরে সাড়ে তিন মাস রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। অন্যদিকে, গ্রেফতার হওয়ার পাঁচ দিন পর পশ্চিমবঙ্গের শিল্পমন্ত্রী, পরিষদীয় মন্ত্রী ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। যেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারির ৫ দিনের মধ্যে পদ থেকে অপসারণ করেন, সেখানে এখন বিরোধিতা করে দুমুখো পরিচয় দিচ্ছেন কেন তৃনমূলে নেতৃত্বেরা?

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ২০২২ সালে প্রকাশিত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ED মোট ১৪৭ জন নেতার ওপর আলাদা আলাদা মামলা দায়ের করেছে।

এর মধ্যে বিজেপি আমলে অর্থাৎ ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১২১ জন নেতার বিরুদ্ধে ED মামলা দায়ের করেছে। আর ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে কংগ্রেস আমলে ED মোট ২৬ জন নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

আপনি জানলে অবাক হবেন, ADR অর্থাৎ অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস এবং NEW অর্থাৎ ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ-এর দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সাংসদ হওয়া ৫৪৩ জন নেতার মধ্যে ২৫১ জন নিজের নির্বাচনী হলফনামায় নিজেদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক মামলা থাকার কথা দায়ের করেছেন। যার মধ্যে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, অপহরণ এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

তাহলে কী এই সংশোধন আদেও লাগু হবে?

বর্তমানে এই বিলটি ৩১ সদস্যের যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। যারা এই সংশোধনীর বিবেচনা করে একটি প্রস্তাবনা দেবেন। আপনাদের জানিয়ে দিই, যৌথ সংসদীয় কমিটিতে লোকসভার ২১জন সাংসদ, রাজ্যসভার ১০ জন সাংসদ রয়েছে। যাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ১৯ জন এবং বিরোধী পক্ষের ১২ জন সাংসদ রয়েছেন।

যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট আসার পর পুনরায় সংশোধিত বিলটিকে লোকসভায় পেশ করা হবে। লোকসভায় পাশ হওয়ার পর এটি রাজ্যসভায় পাঠানো হবে।

তবে, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এবং সাংসদ কপিল সিব্বাল জানিয়েছেন, “এই বিল কখনোই পাশ হবে না। কারণ সংবিধান সংশোধন করার জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন চাই, অর্থাৎ ৩৬৩ জন সাংসদের সমর্থন। কিন্তু NDA-র মাত্র ২৯৩ জন সাংসদ আছেন।

আর এক আইনজীবী বিরাগ গুপ্তা জানান, রাজ্যসভাতেও এই বিল পাশ করাতে গেলে ২৪৫টি সিটের মধ্যে ১৬৪ জনের অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন লাগবে। যেখানে বিজেপির মাত্র ১২০-১৩০জন সাংসদ রয়েছে। এছাড়া, এই বিল লাগু করার ক্ষেত্রে অর্ধেকের বেশি রাজ্যের সহমত দরকার।

যদি এই সমস্ত সংবিধানিক প্রক্রিয়া এড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান সংশোধন করতে চায়, তাহলে সেই বিলের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হতে পারে। অর্থাৎ এই বিলকে আইনে পরিণত করতে বেশ কিছু সময় লাগবে।

Leave a Comment