India Hood Decode: এবার বন্ধ হবে সন্ত্রাসবাদীদের জারিজুরি, POTA বিল আনছে মোদী সরকার!

POTA Bill
POTA Bill

আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগের কথা। আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৫ বছর পর লাগু করা হয় একটি বিল। যে বিল আমাদের দেশে চালু থাকলে হয়তো হতো না কোনও ধরনের কোনও সন্ত্রাসবাদী ঘটনা! ঘটতো না আতঙ্কবাদী কোনও হামলা! দেশের কোথাও হতো না বোমা বিস্ফোরণ। থাকতো না কোনও মিলিট্যান্ট গ্রুপ! হয়তো কোনও ডাক্তার স্বপ্নেও ভাবতো না দিল্লি ব্লাস্টের কথা। আমরা আজ কথা বলছি POTA বিল (POTA Bill) নিয়ে।

তবে, এই আইন চালু করার পর এর বয়স ছিল মাত্র ২ বছর! এই আইন বিজেপি চালু করলেও, ক্ষমতায় এসেই এই বিল রদ করে দেয় কংগ্রেস!

কিন্তু, কী এই বিল, যার নাম শুনলেও কেঁপে উঠত সন্ত্রাসবাদীরা? এখন ফের কেন সংবাদের শিরোনামে এই আইন? দেশে কী এমন হয়েছিল যে এমন কঠোর আইন চালু করতে বাধ্য হয় বিজেপি? কেনই বা এই আইন বন্ধ করে দিয়েছিল কংগ্রেস সরকার?

আজ India Hood ডিকোডে আমরা এক এক করে তুলে ধরবো এমন কিছু তথ্য, এমন কিছু সত্য যা সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার করে দেবে আপনার কাছে!

দেশ তখন একের পর এক সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে জর্জরিত

স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের আতঙ্কবাদী হামলার সম্মুখীন হয়েছে ভারতবাসী। কখনও ১৯৮৫ সালের এয়ার ইন্ডিয়া কনিস্কা বিমান বিস্ফোরণ, তো কখনও ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ে একের পর এক বোমা বিস্ফোরণ।

তবে এত মানুষ মারা যাওয়া সত্ত্বেও, দেশের মধ্যে তখনও লাগু থাকা সন্ত্রাসবিরোধী আইন TADA-কে হঠাৎ করেই ১৯৯৫ সালে তুলে দেয় কংগ্রেস সরকার। যা নাকি অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল। যদিও সন্ত্রাসবাদী হামলা কিন্তু বন্ধ হয়নি ভারতে।

এরপর ১৯৯৯ সালে দেশে বিজেপি সরকার আসে। তবে দেশে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স IC-814 হাইজ্যাক, লাল কিলা হামলা, জম্মু কাশ্মীরের বিধানসভা হামলার মতো একাধিক ঘটনা ঘটতে থাকে।

কিন্তু, ২০০১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনে হামলা সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সন্ত্রাসবাদের শেষ দেখার পণ করে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী, এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি।

আর সেই থেকেই শুরু হয় পরিকল্পানা। ঘেঁটে দেখা হয় ১৮৬০ সালের ভারতীয় দণ্ডবিধি, যা বিভিন্ন অপরাধ এবং তাদের সংশ্লিষ্ট শাস্তি সম্পর্কে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু, দেখা যায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তখনও পর্যন্ত তেমন কোনও আইন ছিল না ভারতের সংবিধানে।

সন্ত্রাসবাদ রুখতে বিশেষ পদক্ষেপ নিলেন বাজপেয়ী

এরপর দিনটা ২০০২ সালের ২১শে মার্চ। লোকসভায় একটি বিল পেশ করে বিজেপি সরকার। জানায় –  নতুন এই বিলে পুলিশ এবং বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থাকে দেওয়া হবে যথেচ্ছ ছাড় অর্থাৎ ফ্রি হ্যান্ড। সাথে অতিরিক্ত ক্ষমতা। যেখানে সাধারণ আইনে গ্রেফতারের ৯০ দিনের মধ্যে চার্জশিট পেশ করতে হয়, সেখানে এই আইনে গ্রেফতার করার পর ১৮০ দিন পর্যন্ত চার্জ শিট না দিলেও সন্দেহভাজন ব্যাক্তিকে আটক করে রাখা যাবে। পুলিশের কাছে করা স্বীকারোক্তিকে আদালতের কাছে গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ IPC/CrPC দিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠন, ফান্ডিং, বিস্ফোরক নেটওয়ার্ক ধরা যায় না, এবার থেকে এই বিলের অধীনে তা করা যাবে। আইনের অধীনে দাখিল হওয়া মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা আদালত গঠন করার কথাও বলা হয়েছিল। যেখানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সন্দেহে যদি কোনও ব্যাক্তিকে আটক করা হয় তাহলে তাঁর সম্পত্তি পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করতে পারবে ভারতীয় এজেন্সি। সরকার যেকোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করতে পারবে। আর এতটাই কঠোর এই বিলের এর নাম ছিল POTA, অর্থাৎ The Prevention Of Terrorism Act।

লোকসভায় এই বিল পেশ হতেই বিরোধিতা করা শুরু করে কংগ্রেস। জানায় এই আইনের দুর্ব্যবহার হতে পারে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে নিরপরাধ মানুষকেও গ্রেফতার করা হতে পারে। পুলিশও এই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে।

তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে পাশ হয় POTA বিল। কিন্তু, রাজ্যসভার বেশিরভাগ সদস্য এই বিলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ায় প্রত্যাখ্যান করা হয় এই বিল।

এরপর দিনটা ২৬শে মার্চ। সংসদের ইতিহাসে তৃতীয় বারের জন্য যৌথ অধিবেশন বসে। উদ্দেশ্য – সেই POTA বিল। ওইদিন বিলটি উত্থাপন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এল.কে. আদবানি। বলেন, শুধু যদি সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে মোকাবিলা করতে হয় তাহলে সাধারণ আইনই যথেষ্ট। কিন্তু যদি কোনও রাষ্ট্র দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, মদতপুষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে মোকাবেলা করতে হয়, সেক্ষেত্রে একাধিক চ্যালেঞ্জ আসবে।“

পাশাপাশি, তিনি জানান, POTA, ২০০১ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাব নং ১৩৭৩-এর সাথে সম্পূরক। সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছে: “যদি কোনও ব্যাক্তি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফান্ডিং, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি বা সংঘটনে বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে, তবে সমস্ত রাষ্ট্র সেই ব্যাক্তিকে বিচারের আওতায় আনবে।”

আদবানি জোর দিয়ে বলেন যে, “এই বিল, ১৯৯৫ সালে বাতিল হওয়া সন্ত্রাসবাদী ও বিঘ্নকারী কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন অর্থাৎ TADA-র অনেক উন্নত সংস্করণ। POTA, সন্ত্রাসবাদী-অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করতে সাহায্য করবে।“ এরপর সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধকারী এই বিলের পক্ষে ভোট দেয় ৪২৫ জন এবং বিপক্ষে ভোট দেয় ২৯৬ জন। ফলত পাশ হয়ে যায় POTA বিল।

তবে, এই বিল পাশ হলেও এর বিরোধিতা করতে থাকে কংগ্রেস। এমনকি ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নিজেদের ঘোষণাপত্রে এটা রদ করার কথা ঘোষণা করে কংগ্রেস। অর্থাৎ, ক্ষমতায় এলেই এই আইন রদ করবে কংগ্রেস সরকার।

হলও তাই। সালটা ২০০৪। ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস সরকার। দেশের প্রধানমন্ত্রী হন ডঃ মনমোহন সিং। তিনি ক্ষমতায় এসেই, ওই বছরের ২১শে সেপ্টেম্বর তুলে দেন এই POTA বিল। এর তিন মাস পর ২১শে ডিসেম্বর বাতিল করে দেওয়া হয় এই আইন। বাতিল করার কারণ হিসাবে বলা হয়, এই আইনটি ভীষণ কঠোর। এত কড়া আইন ভারতে চলবে না। ভারতের মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারবে না। এই আইন অসাংবিধানিক। এই আইনের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ধরা হচ্ছে। তবে, ওই বছরই আতঙ্কবাদী কার্যক্রমকে UAPA অর্থাৎ Unlawful Activities Prevention Act ১৯৬৭-র অধীনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কিন্তু কী এমন হল এই দুই বছরে যে কংগ্রেস সরকারকে এই বিল বন্ধ করতে হল?

এই আগুন লাগু হতেই, সারা দেশ জুড়ে চলে আতঙ্কবাদীদের খোঁজ। ধরা পড়তে থাকে তাদের চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা নেটওয়ার্ক। এর ফলে পুলিশ প্রশাসন এবং বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থাকে এমন অধিকার দেওয়া হয়েছিল, যার বলে – যদি কেউ আতঙ্কবাদী তৈরি করছে, আতঙ্কবাদীকে থাকতে দিচ্ছে, আতঙ্কবাদীকে খেতে দিচ্ছে, কিংবা আতঙ্কবাদিদের মদত দিচ্ছে – এমন সন্দেহ হলেই ধরতে পারবে।

এই আইন লাগু করার পর প্রথম কিছু মাসে জম্মু কাশ্মীর থেকে ১৮ জন, গুজরাত থেকে ২৪০ জন, হরিয়ানা থেকে ২ জন, মধ্যপ্রদেশ থেকে ১ জন করে একের পর এক করে প্রায় ২৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই আইন লাগু হওয়ার ১ বছরের মধ্যে মধ্যে দেশের ৫৪৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

ধরা পড়ে কাশ্মীর, গুজরাত ও দিল্লির একাধিক জঙ্গি মডিউল। লস্কর-এ-তইবা, জইশ-ই-মোহাম্মদ-এর বহু মডিউল ধরা পড়ে। করা হয় অস্ত্র উদ্ধার, ভাঙা হয় ফান্ডিং নেটওয়ার্ক।

তবে, কংগ্রেসের অভিযোগ অনুসারে, এই আইনের ফলে বিভিন্ন সন্ত্রাসমূলক কাজ ও ফান্ডিং, সন্ত্রাসী সংগঠন, অস্ত্র ও বিস্ফোরক নেটওয়ার্ক ধরা পরেছে, সেকথা ঠিকই। কিন্তু, প্রমাণ ও বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা, বিচারহীনতা ও আইনের অপব্যবহারের সম্ভাবনা আইনটিকে “কঠোর এবং ঝুঁকিপূর্ণ” করে তুলেছে। দেখা যায় POTA-তে আটক ৭০% লোকের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।

ফের কেন ট্রেন্ডিংয়ে POTA?

তবে, এবার দীর্ঘ ২৩ বছর পর, অটল বিহারী বাজপেয়ীর সেই আইনকে ফের লাগু করার কথা ভাবছেন ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কারণ ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই, সংসদে বিতর্ক চলার সময়ে তিনি বলেন, POTA “ভোট-ব্যাংক রাজনীতি”-র জন্য বাতিল করা হয়েছিল, যা একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। POTA রদ করার পর “সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বেড়েছে”। যদি POTA রদ না হত, তাহলে কিছু বড় হামলা প্রতিরোধ করা সম্ভব হত। এই একই বক্তব্য ২০২৪ এবং ২০২৫ সালের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাষণে বলতে শোনা গিয়েছে অমিত শাহকে।

দেশে বর্তমানে যে হারে দিল্লি বিস্ফোরণের পাশাপাশি, রিসিন বিষ কাণ্ডের মতো একাধিক ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসছে, সেই ক্ষেত্রে এই আইন কার্যকর বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই বিষয়ে আপনার কী মতামত?

Leave a Comment