কার্তিক মহারাজ (Kartik Maharaj)। একজন সন্ন্যাসী, সমাজসেবক, পেয়েছেন পদ্মশ্রী-ও। আবার তার নামেই রয়েছে ধর্ষণ ও গর্ভপাত করানোর মতো গুরুতর অভিযোগ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে তার সাপে-নেউলে সম্পর্ক! একের পর এক কারণে গত কয়েক মাস ধরেই সংবাদ শিরোনামে তিনি। কিন্তু কে এই কার্তিক মহারাজ? তাঁর আসল পরিচয় কি? কেন তাঁর ওপর এত রাগ মুখ্যমন্ত্রী মমতার? হঠাৎ কেনই বা উঠে এল তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ? আজ সমস্ত তথ্য এই প্রতিবেদনে জানানো হবে আপনাদের।
কে এই কার্তিক মহারাজ? তাঁর পরিচয় কি?
আসল নাম স্বামী প্রদীপ্তানন্দ। বয়স ৬৪ বছর। কিন্তু, সারা দেশে তিনি পরিচিত কার্তিক মহারাজ নামে।
কিশোর বয়সেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ভাবধারাকে ভালোবেসে সঙ্ঘে চলে আসেন কার্তিক মহারাজ। প্রথমে যান পুরুলিয়ার আশ্রমে, সেখান থেকে যান ঔরঙ্গাবাদের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে। ঔরঙ্গাবাদের সঙ্ঘে তিনি দীক্ষা নেন স্বামী প্রজ্ঞানন্দ মহারাজের কাছে। এরপর ধীরে ধীরে হন ব্রহ্মচারী। তখন তার বয়স ২০ থেকে ২২। স্বামী হিরন্ময়নন্দজি মহারাজের তত্ত্বাবধানে শুরু করেন পড়াশোনা, চলতে থাকে আধ্যাত্মিকতা। তখন যৎসামান্য ভিক্ষা থেকে যা আসত, কখনও একবেলা খেতে পেতেন, আবার কখনও পেতেন না।
এইভাবে কয়েকটা বছর চলার পর, ঠিক ১৯৯০ সালে তিনি বেলডাঙ্গায় আসেন। সেখানে ভিক্ষা করেই চলতে থাকে জীবনযাপন। তারপর দুটো টিনের চাল দিয়েই ওই এলাকায় শুরু হয় ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আর একটি শাখা।
কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। বেলডাঙ্গায় একের পর এক কাজ করে গেছেন সাধারণ মানুষের জন্য, এমনকি সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষের জন্য। বেলডাঙায় আসার পর থেকেই আদিবাসী মেয়েদের জন্য হাইস্কুল, প্রাথমিক বিদ্যালয় করেন। তিনি একটা ইটও নিয়ে বেলডাঙায় আসেননি। যা করেছেন ভিক্ষা করেই করেছেন। কিন্তু তাঁর কাজ দেখে পরবর্তীকালে কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে সরকারি সাহায্য় আসা শুরু হয়। এখন বেলডাঙায় ১২টির মতো স্কুল ও হাসপাতাল রয়েছে ভারত সেবাশ্রমের অধীনে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মতো। ছাত্রাবাসে রয়েছে ৪৫০ জনের মতো আদিবাসী বাচ্চা।
এই সমস্ত তথ্য জানিয়েছেন কার্তিক মহারাজের কাছের শিষ্য দিবাকর কর্মকার।
বর্তমানে কার্তিক মহারাজ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের বেলডাঙ্গা শাখার অধ্যক্ষ। গরীব, আদিবাসী ছেলে মেয়েদের শিক্ষাদান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, এমন অনেক সমাজসেবামূলক বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত তিনি। শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি, হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারবার তুলতে থকেন আওয়াজ। হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য গড়ে তোলেন এক বিশেষ সংগঠন, হিন্দু রক্ষী দল।
এই অবধি ঘটনাটা খুবই সাধারণ হওয়ার পাশাপাশি অসাধারণ। তবে ঘটনা বিরাট আকার ধারণ করে ঠিক ২০২৪ সালে।
২০২৪ সালে মুখ্যমন্ত্রীর তোপ ও বিতর্ক
সালটা ২০২৪। লোকসভা নির্বাচন শুরু হওয়ার ঠিক আগেই হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর এলাকা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে হিংসা। এরপর ১৮ মে, নির্বাচনী সভা থেকে সরাসরি কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে হিংসার অভিযোগ তোলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আরামবাগের নির্বাচনী সভা থেকে সন্ন্যাসীকে নিয়ে বলেন, ‘সব সাধু সমান হয় না। সব স্বজন সমান হয় না। আমাদের মধ্যেও কি আমরা সবাই সমান? আমি ভারত সেবাশ্রমকে সম্মান করি। কিন্তু এক ব্যক্তি সন্ন্যাসী হিসেবে তৃণমূল এজেন্টদের বসতে দিচ্ছে না। তাঁর নাম কার্তিক মহারাজ। আমি এটা বরদাস্ত করব না। উনি সরাসরি বিজেপি রাজনীতি করছেন করুন, কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে কেন? এলাকায় এলাকায় গিয়ে আপনি ধর্মের নামে বিজেপি করে বেড়ান।’
ঠিক তার পরের দিন। ১৯ মে, রাজ্যে ভোটের প্রচারে আসেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পুরুলিয়া এবং বিষ্ণুপুরের জনসভা থেকে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সাধুসন্তদের অপমান করার অভিযোগ তুলে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে তোপ দাগেন তিনি।
এরপর ২০ মে, কার্তিক মহারাজ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানহানির আইনি চিঠি পাঠান।
ওই একই দিনে, বিষ্ণুপুরে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যের জবাব দেওয়ার পাশাপাশি নিজের ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে জানান, “তিনি কোনও প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে কিছু বলেননি। ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কয়েক জন সাধু-সন্ন্যাসীর কথা বলেছিলেন। তিনি কার্তিক মহারাজকে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে নিজের বক্তব্যে অনড় থাকেন সেদিন।
এরপর ২১ মে, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে হামলার উদ্বেগ প্রকাশ করে কলকাতা হাই কোর্টে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন কার্তিক মহারাজ।
এরপর কার্তিক মহারাজকে নিয়ে একাধিক আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গের বুকে ওই সন্ন্যাসীকে সমর্থন করে অন্যান্য সাধু-সন্তরা প্রতিবাদ মিছিলও করে।
এরপর ৮ জুন, ফের সংবাদের শিরোনামে আসেন কার্তিক মহারাজ। ঘটনাক্রম কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা। লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন হাইকোর্টে নিরাপত্তার জন্য যে আবেদন করেছিলেন তিনি, ভোট মিটতেই সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে কার্তিক মহারাজকে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা মঞ্জুর করা হয়। নিরাপত্তার দায়িত্বে বহাল করা হয় কেন্দ্রীয় বাহিনীর চার জওয়ানকে।
এরপর ২০২৪ সালের শেষের দিকে, কখনও ব্রিগেডে লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ, কখনও হিন্দু রক্ষী দল শক্তিশালী করতে সদস্য নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়ে একের পর এক হিন্দুত্ববাদী কার্যক্রম চালাতে থাকেন তিনি।
পদ্মশ্রী পুরস্কার তরজা
এরপর সালটা ২০২৫। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে অর্থাৎ ২৫শে জানুয়ারি, দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্মশ্রী পুরস্কার ২০২৫ এর জন্য নাম ঘোষণা করা হয় স্বামী প্রদীপ্তানন্দ ওরফে কার্তিক মহারাজের। আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি সমাজে তার বিশেষ অবদানের জন্য তাকে এই সম্মান দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। যার পরে ফের উঠে আসে রাজনৈতিক মতভেদ। কার্তিক মহারাজকে পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করাকে রাজনীতিকরণের নিদর্শন হিসাবে আখ্যা দেয় তৃণমূল এবং বাম–কংগ্রেস। অন্যদিকে, এই নির্বাচনকে যথাযথ আখ্যা দেয় বিজেপি।
ধর্ষণের অভিযোগ
এরপর ২০২৫ সালের ২৮শে জুন।
হঠাৎ মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানায় এক মহিলা, কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও জোর করে গর্ভপাত করানোর অভিযোগ আনেন। তিনি জানান, ২০১৩ সালে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানার অন্তর্গত চাণক্য এলাকায় এক আশ্রমের প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে তাকে শিক্ষিকার পদে নিয়োগ করে, স্কুলে থাকার জন্য একটি ঘরও দেওয়া হয়। সেখানেই এক রাতে ওই মহারাজ আচমকা হাজির হয়ে তাকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। বাধ্য হয়ে তা মেনে নেন তিনি। একদিন নয়, দিনের পর দিন শারীরিক অত্যাচার চালানো হয় তার ওপর। এরপর ওই মহিলা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে জোর করে তার গর্ভপাত করানো হয়। এমনটাই অভিযোগ মহারাজের বিরুদ্ধে। গত বৃহস্পতিবার রাতে এই মর্মে কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন ওই মহিলা।
এরপর ৩০ জুন, প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস, প্রতারণা এবং জোর করে গর্ভপাত করানোর অভিযোগের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ১ লা জুলাই কার্তিক মহারাজকে মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানায় হাজির হতে বলা হয়।
তবে, এই অভিযোগ অস্বীকার করেন কার্তিক মহারাজ।
শুধু তাই নয়, ১ লা জুলাই তিনি থানায় না গিয়ে সরাসরি কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া এফআইআর খারিজ করার আবেদন জানিয়ে কার্তিক মহারাজ উল্লেখ করেন, “আমি ভারত সেবাশ্রম সংঘের মানুষ। পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছি। একজন মহিলা থানায় গিয়ে বলেছে ১৩ বছর আগে কিছু হয়েছে। তার ভিত্তিতে FIR দায়ের করেছে। নোটিস দিয়ে আজই আমাকে যেতে বলেছে। সাধু-সন্তদের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে।” বুধবার অর্থাৎ ২রা জুলাই এই মামলার শুনানির থাকলেও, সেই মামলায় সময় চেয়ে নেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল। যার পর সেই আবেদন মঞ্জুর করে ৩রা জুলাই এই মামলার শুনানি হয় হাইকোর্টে। সেখানে আপাতত ৭ই জুলাই পর্যন্ত কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে রাজ্যকে। অন্যদিকে, এই মামলায়, কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে একাধিক মিথা অভিযোগ তুলে তাঁকে অসম্মান করার কারণ দেখিয়ে রুদ্ধদার অর্থাৎ ইন-ক্যামেরা শুনানির আবেদন জানিয়েছেন কার্তিক মহারাজের আইনজীবি। তবে, এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে রাজ্য সরকার।
প্রশ্ন একাধিক। আদেও কি অভিযোগ সত্য? নাকি মহারাজকে কলুষিত করার জন্য এই মামলা? শুধুমাত্র হিন্দুদের হয়ে গলা তোলার জন্যই কি এতবার টার্গেট করা হচ্ছে তাঁকে? ১৩ বছরের পুরানো এই ঘটনা কি মহারাজের এত দিনের সম্মান শেষ করবে? উত্তর দেবে ভারতের বিচারব্যবস্থা। তবে, আপনারা জানাতে ভুলবেন না আপনাদের মতামত। সাথে জানাতে ভুলবেন না কোন বিষয় নিয়ে আপনারা জানতে চাইছেন, আপনারা জানান, আমরা উপস্থান করবো নিরপেক্ষ তথ্য, আপনাদের জন্য!