ঘড়ির কাঁটায়, ঠিক সন্ধ্যা ৬টা ৫২। হঠাৎই কেঁপে উঠল দিল্লি (Delhi Blast)। দাউদাউ করে জ্বলল আগুন। চারিদিকে ঝলসে যাওয়া দেহ আর রক্ত। বাতাসে বারুদের গন্ধ, আর রাস্তায় মানুষের আর্তনাদ। প্রাণ হারায় বহু মানুষ, অনেকের ফেটে যায় কানের পর্দা। সেই মুহূর্তে কেউ বুঝতে না পারলেও, পরে সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে এই আতঙ্কবাদী ঘটনা। আর তারপরেই সারা দেশজুড়ে জারি হয় রেড অ্যালার্ট। সারা ভারত জুড়ে চলতে থাকে তদন্ত। আর ঠিক ৯ দিন পর উঠে এল মারাত্মক রিপোর্ট।
টেরোরিস্ট অ্যাটাক নাকি প্যানিক অ্যাটাক – ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? কীভাবেই বা ঘটানো হল এই কাণ্ড? কারা ঘটালো এই ঘটনা? কী প্ল্যানিং ছিল জঙ্গীদের? আজ India Hood ডিকোডে আমরা এক এক করে তুলে ধরবো সমস্ত তথ্য। তাই ধৈর্য ধরে বসুন, কারণ আজ আমরা আপনাদের জানাবো এমন কিছু তথ্য, দেবো এমন কিছু প্রমাণ যা সমস্ত কিছু পরিষ্কার করে দেবে আপনার চোখের সামনে।
ঘটনার সুত্রপাত কবে থেকে?
পহেলগাঁও আক্রমণের পর অপারেশন সিঁদুর করে যোগ্য প্রতিশোধ নিয়েছিল ভারত। গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের একাধিক জঙ্গি ঘাঁটি। যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তক্কে তক্কে ছিল পাকিস্তানের ISI আর জয়েশ-ই-মহম্মদ। না, প্রমাণ ছাড়া আমরা কিছু বলছি না! বরাবরের মতোই আজও সবটাই বলবো প্রমাণ সহ।
দিনটা ২০২৫ সালের ৯ই অক্টোবর। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-য় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠী জয়েশ-ই-মহম্মদ নিজেদের প্রথম মহিলা শাখা – জামাত-উল-মোমিনাত গঠনের ঘোষণা করেছে। এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মাসুদ আজহারের বোন সাদিয়া আজহারকে। যার স্বামী ইউসুফ আজহারের মৃত্যু হয়েছে অপারেশ সিঁদুরে। এই উদ্দেশ্যে তারা একটি চিঠির মাধ্যমে জঙ্গি নিয়োগের ঘোষণাও করে।
এরপর ১৯শে অক্টোবর, জম্মু কাশ্মীরের নওগামে পুলিশ একটি পোস্টার দেখতে পায়। যে পোস্টারে দেওয়া ছিল সরাসরি হুমকি। ঠিক কী লেখা ছিল?
আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন এবং আমাদের দেওয়া পরামর্শ মেনে চলবেন। আমরা বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি যে আপনারা এখনও পাপ কাজে লিপ্ত। তাই, আমরা বলতে চাই যে আপনারা শরিয়া আইন লঙ্ঘনকারী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকুন, নতুবা আমরা শরিয়া আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। কিছু লোক এই ব্যক্তিদের এই কার্যকলাপে সমর্থন করে। আমরা তাদের বলতে চাই যে, বিরত থাকুন, এটাই শেষবার, আপনাদের ক্ষমা করা হবে না, এবং, আল্লাহর ইচ্ছায়, সময় এলে তারা তাদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবে। কিছু লোক তাদের দোকানে এই ভারতীয় পশুদের আশ্রয় দেয়, যা আমাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। তাই, আমরা তাদের খোলাখুলিভাবে বলতে চাই যে, বিরত থাকুন, নতুবা তাদেরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষ করে শ্রীনগরের নওম বানপোরা এলাকায়, এমন অনেক লোক আছে যারা তাদের দোকানে এই ভারতীয় পশুদের আশ্রয় দেয়। আমি আশা করি আপনারা বুঝতে পারবেন।
এই পোস্টার ছিল একপ্রকার প্রকৃত ভারতীয় মুসলিমদের উদ্দেশ্যে, যারা ভারতীয় সেনাদের বরাবর জম্মু-কাশ্মীরে সাহায্য করে আসছে। তাদের উদ্দেশ্যেই লেখা ছিল – “আমরা বেশ কিছু সময় ধরে দেখছি আপনারাও পাপ কাজ করছেন। আপনারা শরীয়া বিরোধী কাজ বন্ধ করুন। কিছু লোক এই ভারতীয় পশুদের নিজেদের দোকানে জায়গা দেয়। যার ফলে আমাদের কাজে অসুবিধা হয়। তাই সবাই সাবধান হয়ে যাও, নাহলে পদক্ষেপ কঠোর হবে।“
তারা শ্রীনগরের নম বনপোরা এলাকার নামও উল্লেখ করে। পোস্টারের নীচে লেখা ছিল কমান্ডার ইঞ্জালা ভাই। তারিখ ১৭ই অক্টোবর, ২০২৫।
অর্থাৎ, সারা ভারত যখন দিপাবলির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। মহিলা বিশ্বকাপ নিয়ে ব্যস্ত। তখনই দেশের এক প্রান্তে চলছে এই ধরনের হিংসা এবং ঘৃণা ছড়ানোর কাজ।
২০১৯ সালের আগে এই পোস্টার পড়া স্বাভাবিক হলেও, আর্টিকেল ৩৭০ ধারা রদ করার পর থেকে এই ঘটনা কমে গিয়েছিল। এমনকি ২০১৮ সালের আগে জম্মু কাশ্মীরে সশস্ত্র আক্রমণের সংখ্যা ছিল ৫৯৭, সেখানে ২০২৫ সালে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ১৪৫-এ। তাই, সম্প্রতি এমন পোস্টার দেখে কিছুটা অবাক হন এসএসপি জি.ভি. সুদীপ চক্রবর্তী। তিনি বিষয়টিকে হালকাভাবে নেন না, বরং নির্দেশ দেন গভীর তদন্তের।
তদন্তের শুরুতেই একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা শুরু করে তদন্তকারীরা। আর তাতেই পোস্টার মারা একজন ব্যাক্তিকে শনাক্ত করা হয়, শুরু হয় স্থানীয় লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করাও।
এরপর ৬ই নভেম্বর, উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর থেকে ওই ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী তদন্তে জানা যায়, ওই ব্যাক্তি কাশ্মীরের কুলগামের ওয়ানপোরা গ্রামের বাসিন্দা ডঃ আদিল আহমেদ রাদের। সে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনন্তনাগের গভর্নমেন্ট মেডিকেল কলেজের সিনিয়র রেসিডেন্ট ছিল। পরে সাহারানপুরের ফেমাস মেডিকেয়ার হাসপাতালে মাসিক ৫ লক্ষ টাকা বেতনের বিনিময়ে ডাক্তারিতে যোগ দেয়। তল্লাশি করে পুলিশ, আদিলের আগের কলেজের লকার থেকে একটি AK-47 রাইফেল এবং কার্তুজ উদ্ধার করে।
তারপর জেরায় আদিলের সাথে JeM এবং আনসার ঘাজওয়াত-উল-হিন্দের যোগাযোগ সামনে আসে। জেরায় উঠে আসে আর এক জঙ্গি ডঃ মুজাম্মিল শাকিল গনাইয়ের নাম। অন্যদিকে, গুজরাত থেকেও গ্রেফতার করা হয় এক চিকিৎসক সহ আরও দুজনকে। যারা রিসিন বিষ তৈরি করে হিন্দুদের মারার চক্রান্ত করছিল।
এরপর ৯ই নভেম্বর, পুলিশ, মুজাম্মিলকে গ্রেফতার করে। এবং জেরা করে জানতে পারে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। তথ্য পেয়ে পুলিশ ফরিদাবাদে অভিযান চালায়, এবং ধৌজ ও ফতেহপুর তাগা গ্রামের দুটি ভাড়া করা ঘর থেকে প্রায় ২৯০০ কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সহ রাইফেল, পিস্তল, ব্যাটারি, রিমোট, ডিটোনেটর সহ অন্যান্য মারণ অস্ত্র উদ্ধার করে। আপনাদের জানিয়ে দিই, ১ কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট প্রায় ০.৫৭১৪ কেজি RDX-এর সমান। আর সেই হিসাব অনুসারে ২,৯০০ কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে প্রায় ১,৬৫৭ কেজি RDX তৈরি করা যাবে। পুলওয়ামার কইল গ্রামের ৩৫ বছরের যুবক মুজাম্মিল পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। কাজ করতেন ফরিদাবাদের আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বছরে কামাতেন ৯ লক্ষ টাকা। মুজাম্মিলকে জেরা করে উঠে আসে ডঃ উমর নবী এবং ডঃ শাইন সাইদ সহ আরও অনেকের নাম।
এরপর দিনটা ১০ই নভেম্বর। পুলিশ তদন্তে এগোতে যাবে কি হঠাৎ করেই কেঁপে ওঠে দিল্লি। ঠিক সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে দিল্লির রেড ফোর্টের কাছে সুনেহরি মসজিদের পার্কিং থেকে একটি সাদা হুণ্ডাই i20 গাড়ি বেরোয়। গাড়িটি লালকেল্লার কাছে ইউটার্ন নিয়ে, লালকেল্লার সামনের রাস্তায় আসে। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৬টা ৫২, ধীর গতিতে গাড়িটি সুভাষ মার্গের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে যায়। এই সিগন্যালটি লাল কেল্লা মেট্রো স্টেশনের গেট নং ১-এর খুব কাছেই ছিল। আর তখনই হয় একটি বিরাট বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের মাত্রা এতটাই ছিল যে আশেপাশের ৬টি গাড়ি এবং ৩টি অটো রিক্সায় আগুন লেগে যায়। এমনকি ৪০০ মিটার দূরে দাঁড়ানো একটি গাড়িতেও এই বিস্ফোরণের প্রভাব পড়ে। রাস্তার লাইট নিভে যায়, পাশের মেট্রো গেটে লাগানো কাঁচ ভেঙে যায়। বিস্ফোরণের জায়গা থেকে কিছু দুরেই ছিল একটি জৈন মন্দির। বিস্ফোরণে তারও কাঁচ ভেঙে যায়। ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যু হয় এবং ২০ জন আহত হয়। যাদেরকে লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। ঘটনার দুই দিন পর, প্রাথমিক ময়নাতদন্তের ফলাফলে জানা যায় যে নিহতদের কানের পর্দা, ফুসফুস এবং অন্ত্র ফেটে গিয়েছে এবং একাধিক ফ্র্যাকচার সহ গুরুতর আঘাতের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ এখান থেকে বোঝা যায় বিস্ফোরণটি কতটা গুরুতর ছিল।
এরপরেই আগের ধৃতদের থেকে জানা যায়, গাড়িতে থাকা ওই জঙ্গি হয়তো ২৯ বছর বয়সী ডঃ উমর নবী। পুলিশ নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওই দিনই বিস্ফোরণের পর পুলওয়ামার কোইলে উমরের বাড়িতে যায়। তার ভাই জাহুর ইলাহি এবং আসিক হুসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়। এবং সংগ্রহ করা হয় তার মায়ের DNA স্যাম্পেল। এরপর ১৩ই নভেম্বর উঠে আসে প্রমাণ। ওই মহিলার স্যাম্পেল বিস্ফোরণ হওয়া গাড়ির চালকের সাথে ম্যাচ হয়।
উমর নবির বাড়ি জম্মু কাশ্মীরের পুলওয়ামার কোইল গ্রামে। শ্রীনগরের এক মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারির পড়াশোনা করেছে সে। ২০১৭ সালে এমবিবিএস পাশ করে। বর্তমানে সে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে আল ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াত।
ঘটনার পরেই একে একে গ্রেফতার হতে থাকে এই গ্রুপের আরও সদস্য। লখনউয়ের ডঃ শাহীন সাঈদ, শ্রীনগরের নওগাম থেকে আরিফ নিসার দার, ইয়াসির-উল-আশরাফ দার, মাকসুদ আহমেদ দার, শোপিয়ান থেকে এক মৌলবী ইরফান আহমেদ, ওয়াকুরা, গান্ডারবাল থেকে জমির আহমেদ আহংগার এবং আর এক মৌলবী হাফিজ ইস্তিয়াককেও গ্রেফতার করা হয়। পরে ধরা হয় শাহীন সাঈদের ভাই পারভেজ আনসারিকেও।
এদের মধ্যে ডঃ শাহীন সাঈদকে সবথেকে ভয়ঙ্কর হিসাবে ধরা হচ্ছে। কারণ, তিনি ছিলেন জামাত উল মোমিনাতের নিয়োগকর্তা এবং কমান্ডার। জামাত উল মোমিনাত অর্থাৎ জয়েশ-ই-মহম্মদের মহিলা শাখা। শাইন জানিয়েছে, তার কাজ ছিল, তরুণ মেয়েদের র্যাডিকালাইজ করা, বিশেষ করে যারা ডাক্তারি পড়ছে, এবং বিদেশে যেতে চায়। শিক্ষিত মেয়ে, ডক্টর, হোয়াইট কলার কর্মী যাদের আপনি কখনো সন্দেহ করবেন না। মাসুদ আজহারের বোন সাদিয়া আজহারের সাথে সরাসরি সম্পর্ক ছিল সাইনের।
১২ই নভেম্বর এই ঘটনাকে ভারত সরকারের তরফ থেকে আতঙ্কবাদী ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। সরকার কিন্তু আতঙ্কবাদী আক্রমণ বলেনি, আতঙ্কবাদী ঘটনা বলেছে। এটা মাথায় রাখবেন।
এরপর র্যাডারে নেওয়া হয় আল ফালাহ ইউনিভার্সিটিকে। হেফাজতে নেওয়া হয় ৫০ জনের বেশি ছাত্রকে। একজনকে গ্রেফতার করা হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকেও। জম্মু-কাশ্মীরের একাধিক বাড়িতে চালানো হয় তল্লাশি। উড়িয়ে দেওয়া হয় উমর নবীর বাড়ি। ওঠে তুরস্ক যোগের কথাও। এখনও পর্যন্ত এই ঘটনা সম্পর্কে যা যা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া হল। এবার আমরা আপনাদের এই বিস্ফোরণের সাথে জড়িত কিছু অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানাবো।
কেন এই ঘটনা ঘটিয়েছে উমর?
অনেক মিডিয়া বলছে ভয় পেয়ে, ভুল করে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে উমর। আদেও কি তা সত্য?
একে একে সমস্ত সঙ্গীরা ধরা পড়ছিল, ফলত ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি গাড়িতে চড়ে ফরিদাবাদ থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল উমর। যাতে মজুত থাকা বাকি বিস্ফোরক অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
আবার, এমনটাও হতে পারে যে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই ‘প্রমাণ’ লোপাট করতে অবশিষ্ট বিস্ফোরক দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফেলে উমর।
এই বিষয়ে প্রাক্তন RAW এজেন্ট লাকি বিস্টের বক্তব্য – এটি ভুল করে বা ভয় পেয়ে করা কোনও বিস্ফোরণ নয়। হ্যাঁ, ধরা পড়ার একটা ইঙ্গিত হয়তো পেয়েছিলেন উমর, তাই শেষ চেষ্টা করেছিলেন যতটা সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি করা যায়, তাই জনবহুল এলাকা দেখে, এই কাণ্ড ঘটিয়ছে সে।
কীভাবে দিল্লির আল ফালাহ ইউনিভার্সিটি জঙ্গি ঘাঁটি হয়ে উঠল? ইতিহাস কী বলছে?
হরিয়ানার ফরিদাবাদের ধৌজ গ্রামের আল-ফালাহ্ মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল এখন দেশের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯৭ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসাবে আল-ফালাহ্-র যাত্রা শুরু। ৭৬ একর জমির উপর গড়ে ওঠা কলেজটির সঙ্গে পরবর্তী সময়ে জুড়ে যায় মেডিক্যালও। গড়ে ওঠে হাসপাতালও। ২০১৯ সালে আল-ফালাহ্ মেডিক্যাল কলেজে স্নাতক ডিগ্রি শুরু হয়। দু’বছর পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও চালু হয়। ২০১৪ সাল থেকে ‘আল-ফালাহ্ চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর অধীনে কলেজটি পরিচালিত হয়।
দিল্লি বিস্ফোরণের পর থেকে, কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাক জানিয়েছে, এই আল-ফালাহ্কে কোনও দিন স্বীকৃতিই দেয়নি তারা। তবুও এই সংস্থা ওয়েবসাইটে ন্যাক অনুমোদনের দাবি করেছে। পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল নিয়ে আলাদা ভাবে তদন্তে নেমেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট অর্থাৎ ইডি। অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটির তরফ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেম্বারশিপ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা জাভেদ আহম্মেদ সিদ্দিকির বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। দিল্লির নিউ ফ্রেন্ডস কলোনি থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলা অনুযায়ী সাড়ে ৭ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে তিন বছর জেল হয়েছিল সিদ্দিকির।
এমনকি বর্তমানে ধৃত তিন সন্দেহভাজনের মধ্যে শাহিন সাইদ এবং মুজাম্মিল শাকিলকে নিজে থেকে নিয়োগ করেছিলেন প্রতিষ্ঠাতা জাভেদ আহম্মেদ সিদ্দিকি। জানা গিয়েছে এখানে এমন লোকেদেরও ডেকে চাকরি দেওয়া হত যাদের অন্য চিকিৎসা সংস্থা থেকে বহিষ্কার করা হত। এখন গোয়েন্দাদের নজরে এই প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ই। জানা গিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ নম্বর আবাসিক ভবনের ১৩ নম্বর রুমেই বসত জঙ্গিদের আসর।
হঠাৎ তুরস্ক যোগের কথা উঠল কেন?
উমর নবী, আদিল এবং গণাই ২০২১ সালে তুর্কি ভ্রমণ করেছিল, এবং সেখানে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় কাটিয়েছিল। সেখানে তারা প্রায় ১৪ জনের সাথে দেখা করেছে বলে জানা গিয়েছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সমস্ত জঙ্গিদের কাছ থেকে অর্ডার আসছিল তুরস্কের এক হ্যান্ডেলারের কাছ থেকে।
তবে, আদেও এই হামলার পিছনে তুরস্কের কোনও হাত আছে কিনা সেই নিয়ে কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। কিংবা এই নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
কিন্তু, কী এই হোয়াইট কলার র্যাডিকালাইজেশন?
এখনও পর্যন্ত দিল্লি বিস্ফোরণের আগে এবং পরে যত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই চিকিৎসক এবং মৌলবি।
এর আগে পুনেতে ৩৭ বছর বয়সী জুবের হাঙ্গারগেকার নামের একজন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যিনি বছরে আয় করতেন ২৫ লক্ষ টাকা। মহারাষ্ট্র ATS তাকে গ্রেফতার করে কারণ তাঁর ল্যাপটপে ছিল আল কায়েদা, বোম তৈরির এবং AK47 তৈরির নির্দেশিকা।
গুজরাতের রিসিন কাণ্ডেও ধরা হয়েছে একজন চিকিৎসককে।
অর্থাৎ, জঙ্গীরা এমন একটি গ্রুপকে বেছে নিয়েছে, যারা এই সমস্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে নিলেও কোনও সন্দেহ হবে না। যারা সমাজে মিশে যেতে পারবে নিমেষেই। আর কাউকে বাইরে থেকে পাঠাতে হচ্ছে না, দেশের মাটিতেই তৈরি হচ্ছে দেশের শত্রু। ভয় নেই বর্ডারে ধরা পড়ারও।
অর্থাৎ, ভালো করে দেখুন কখনও চলছে ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে জঙ্গিহানা, আর ব্যবহার হচ্ছে ফোন, ল্যাপটপ। তাই বলা হচ্ছে ইলেকট্রনিক জিহাদ।
হোয়াইট কলার বলতে বোঝানো হয় সমাজের এমন একটি শ্রেণী যারা দৈনিক শ্রমিক নন, মজুরি খাটেন না। অফিসে বসে, সম্মানীয় কাজ করেন। এই শ্রেণীর মধ্যে মৌলবাদ ঢুকিয়ে করা হচ্ছে হোয়াইট কলার র্যাডিকালাইজেশন।
আবার অনেকে বলছে SIP টেরোরিজম। অর্থাৎ, মিউচ্যুয়াল ফাণ্ডে আপনি যেমন সিস্টেমেটিকভাবে টাকা বিনিয়োগ করেন। সেইভাবে এখানেও একটা সিস্টেমে জঙ্গি আক্রমণ করানো হচ্ছে।
আর এদেরকে মগজ ধোলাই করানো হচ্ছে এই বলে যে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে।
আমাদের প্রশ্ন, আমাদের বিশ্বের ৫০টি দেশ মুসলিম দেশ, আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা মুসলিমদের, তারা অত্যাচারিত? তারা নিপীড়িত? কোন দিক থেকে? অত্যচারিত ও নিপীড়িত-র সংজ্ঞা কী?
ভারতের হিন্দুরাও তো এই সমস্ত আতঙ্কবাদের জন্য নিপীড়িত, অত্যচারিত। কখনও পহেলগাঁও, কখনও দিল্লি বিস্ফোরণ। কই তারা তো হাতিয়ার তুলে নিচ্ছে না, তারা তো কাউকে মারছে না, তাহলে পয়েন্টটা কী?
এমনকি বৈষ্ণোদেবী মন্দির তীর্থ মেডিকেল কলেজ, জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষদের, প্রধানত মুসলিমদের জন্য অতিরিক্ত সংরক্ষণ দেয়। কই তখন তো ইসলামোফোবিয়া নেই এই কথা কেউ বলে না!
তদন্তে উঠে আসছে ভয়ানক প্ল্যানিংয়ের কথা!
তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই ঘনাচ্ছে রহস্য। উঠে আসছে একের পর এক মানুষ মারার ছক।
প্রথমত, তদন্তে জানা গিয়েছে, এই জঙ্গি দল অনেক আগেই ২৬শে জানুয়ারি লাল কেল্লার রেকি করেছে। অর্থাৎ তারা ভালোভাবেই জানে এখানে কী পরিমাণ নিরাপত্তা থাকবে। তাই হয়তো তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল ২০২৬-এর ২৬শে জানুয়ারি!
দ্বিতীয়ত, অনেকেই বলছে রাম মন্দির, কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ছিল আক্রমণের লক্ষ্য। এটা কিছুটা হলেও সত্যি হতে পারে, কারণ এদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে যাতায়াত করেছে, একজনকে সেখান থেকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, জানা যাচ্ছে এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিশোধ। কারণ তদন্ত শুরু হতেই জানা যায়, দেশে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ছক কষা হয়েছিল। আর সেই তালিকায় ছিল দিল্লির ছ’টি জায়গা। আর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বর্ষপূর্তি কিন্তু ৬ই ডিসেম্বর।
এখানেই শেষ নয়। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল। আর ২০২৫ সালে তার ৩৩তম বর্ষপূর্তি ছিল। আর তদন্তে জানা গিয়েছে বিস্ফোরণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ৩২টি গাড়িকে। আর একটি গাড়ির মাধ্যমে ইতিমধ্যেই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। আর মাসুদ আহজার অতীতে একাধিকবার এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিশোধ নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
যদিও এই পুরোটাই একটি থিওরি। কারণ কিছুই প্রমাণিত হয়নি এবং সরকারও কিছু জানায়নি।
তবে আরও একটি রিপোর্ট অনুযায়ী জানা গিয়েছে, একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ২৫ জন সহযোগীর একটি তালিকা পাওয়া গিয়েছে। ৮ই থেকে ১২ই নভেম্বর পর্যন্ত পরপর বিস্ফোরণের তারিখ ঠিক করা হয়েছিল।
এই হামলা কারা করিয়েছে?
দিল্লির আক্রমণের পর এখনও পর্যন্ত দায় নেয়নি কোনও জঙ্গি সংগঠন। তবে, তদন্তে করে ধৃত জঙ্গিদের সাথে যোগ পাওয়া গিয়েছে আনসার ঘাজওয়াত-উল-হিন্দের। এখন প্রশ্ন, কারা এই আনসার ঘাজওয়াত-উল-হিন্দ? তবে কি এই আক্রমণে কোনও হাত নেই জয়েশ-ই-মহম্মদের?
আপনাদের আগে জানতে হবে কী এই আনসার ঘাজওয়াত-উল-হিন্দ। ২০১৭ সালে এই গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে জাকির মুসা। এর আগে জাকির মুসা হিজবুল মুজাহিদের অংশ ছিল, এবং কাশ্মীর থেকে অপারেট করতো। সেখানে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর জাকির মুসাকে আনসার ঘাজওয়াত-উল-হিন্দের সাথে জোড়ে ISI।
জিওপলিটিক্যাল বিশেষজ্ঞ পভনীত সিংয়ের মতে – এই আনসার ঘাজওয়াত-উল-হিন্দের নেতৃত্বে দেয় আল কায়েদা। অর্থাৎ, নেতৃত্ব আল কায়েদার, কিন্তু, কমান্ডার থেকে জঙ্গি সব কিছু সাপ্লাই করছে ISI। অর্থাৎ আক্রমণ হলে ISI সব দায় চাপিয়ে দেবে আল কায়েদার ওপর। কারণ ISI জানে, সরাসরি ভারতে আক্রমণ করলে তাঁর প্রতিশোধ এত ভয়ঙ্কর হচ্ছে, যে হয়তো পাকিস্তানই আর বাঁচবে না।
আপনাদের ছোট ছোট কিছু ঘটনা জানিয়ে দিই। এই আক্রমণের পর জম্মু কাশ্মীরের MLA মহম্মদ ইউসুফ তারিগামি জানান, নিরিহদের অত্যচার করা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের নামে। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দিরামাইয়া, ভোটের আগে এই বিস্ফোরণ হওয়ার জন্য এই বিস্ফোরণ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে।
তবে, কেন্দ্রীয় সরকার এটিকে এখনও কোনও বিদেশী আক্রমণ হিসাবে আখ্যায়িত করেনি। পরবর্তী পদক্ষেপও কী হবে জানায়নি। আমাদের এই প্রতিবেদন সম্পূর্ণরূপে কিছু নিশ্চিত তথ্য এবং বেশ কিছু সংবাদ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা। আমাদের উদ্দেশ্য – সমস্ত তথ্য আপনাদের কাছে তুলে ধরা। এই বিস্ফোরণ নিয়ে আপনার কী মতামত?