ভাবুন তো…একদিন হঠাৎ করেই জানতে পারলেন আপনার পুরো জেলাটাই লিখে দেওয়া হয়েছে কোনও এক প্রাইভেট কোম্পানির নামে! কি অবাক হচ্ছেন? সম্প্রতি ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে বিজেপি শাসিত অসম রাজ্যে। যেখানে একশো কিংবা দু’শো নয়, পুরো ৩০০০ বিঘা জমি দিয়ে দেওয়া হয়েছে এক প্রাইভেট কোম্পানিকে। বেঘর হয়েছেন প্রায় ১৪,০০০ মানুষ! বিরোধীদের দাবী, আদানিকে এই জমি দিয়ে দিয়েছে অসমের বিজেপি সরকার!
যে ঘটনা শুনে অবাক স্বয়ং হাইকোর্টের (Gauhati High Court) বিচারপতি, সেই ঘটনাই আজ জায়গা পাচ্ছে না মেন স্ট্রিম মিডিয়ায়! ঠিক কি হয়েছে অসমে? কেন দিয়ে দেওয়া হল একসাথে ৩০০০ বিঘা জমি? সত্যি কি আদানির সাথে ডিল করে কোনও স্ক্যাম করছে অসমের বিজেপি সরকার? আজ এক এক করে সমস্ত অজানা তথ্য ডিকোড করবে India Hood।
প্রথমেই জানতে হবে, কি এই অসমের জমি মামলা!
সালটা ২০২৪-এর অক্টোবর মাস। অসম রাজ্যের দিমা হাসাও জেলার উমরাংসো-তে প্রাথমিকভাবে ২,০০০ বিঘা জমি বরাদ্দ করা হয় মহাবল সিমেন্ট নামক এক প্রাইভেট কোম্পানিকে; এরপর নভেম্বর মাসে আরও ১,০০০ বিঘা জমি বরাদ্দ করা হয় ওই সংস্থাকেই। অর্থাৎ, মোট ৩০০০ বিঘা জমি। এই জমি আগামী ৩০ বছরের জন্য মূলত সিমেন্ট কোম্পানি নির্মাণ এবং খনন কাজের উদ্দেশ্যে সরকারের তরফ থেকে টেন্ডার ডেকে লিজে দেওয়া হয়। এই এলাকাটি ভারতীয় সংবিধানের অধীনস্থ ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্গত। এছাড়াও, এই এলাকাটি একটি পরিবেশগত হটস্পট, যা পরিযায়ী পাখি এবং বন্যপ্রাণীদের বিশ্রামস্থল হিসাবে বিখ্যাত।
কিন্তু এর অনেক আগেই ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে DHAC অর্থাৎ দিমা হাসাও স্বায়ত্তশাসিত কাউন্সিলের একজন ওই এলাকায় আসেন। তিনি কোন আলোচনা না করেই, ঘোষণা করেন, যে তাদের জমি একটি বেসরকারি কোম্পানির প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এরপর গ্রামবাসীদের NOC স্বাক্ষর করানো হয় এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হয় দুই লক্ষ টাকার চেক। অন্যদিকে গ্রাম প্রধানদের দেওয়া হয় ১৫ লক্ষ টাকা করে।
এরপর হঠাৎ করেই গ্রামবাসীরা জানতে পারে, এই জমি অধিগ্রহণে সহায়তা করার জন্য DHAC ৫০ কোটি টাকা পেয়েছে। এই খবর ছড়াতেই, ২০২৪ সালের ১৬ই মে, উমরাংসো এলাকার ২২ জন গ্রামবাসী NCHAC-কে অভিযোগ করেন। তারা জানান, DHAC যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই জমিটি মঞ্জুর করেছে।
এরপর ৩১শে জুলাই, হঠাৎ করেই জমি দখল করার জন্য বুলডোজার সহ একাধিক যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হন DHAC-র কর্মকর্তারা। গ্রামবাসীরা কাজে বাধা দিতে গেলে DHAC-র একজন নির্বাহী সদস্য মনোজিৎ নাইডিং নিরাপত্তা কর্মীদের কাছ থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানোর জন্য গুলি চালায়। তাতেও কাজ না হলে নির্যাতনের ভয় দেখানো হয়।
এরপর মামলা দায়ের করা হয় গুয়াহাটি হাইকোর্টে…
এরপর আগস্ট মাসে একজন সমাজসেবী বাবোজিৎ লাংথাসা একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। তবে তিনি যেহেতু গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন না, ফলে কোর্ট তাকে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সাক্ষ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেয়। এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে, গ্রামবাসীরা নিজেরাই একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে গৃহীত হয়। ওই রিট পিটিশনে গ্রামবাসীরা জানায়, আমাদের পরিবার ১৯৭৫ সাল থেকে এই জমিগুলিতে বৈধভাবে বসবাস এবং চাষাবাদ করে আসছে এবং গ্রামের প্রধান ও বয়স্কদের মাধ্যমে DHAC-কে ধারাবাহিকভাবে কর প্রদান করে আসছে।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মহাবল সিমেন্ট কোম্পানির তরফ থেকেও একটি মামলা দায়ের করা হয় হাইকোর্টে। যেখানে নির্মাণ কাজে “স্থানীয় গ্রামবাসীদের দ্বারা সৃষ্ট ঝামেলা” থেকে সুরক্ষা চাওয়া হয়।
এরপর ২০২৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি, এই মামলার প্রথম শুনানি হয় গুয়াহাটি হাইকোর্টে। সব কিছু শুনে কোর্টের তরফ থেকে আবেদনকারীদের মালিকানাধীন ৩,০০০ বিঘা জমি কীভাবে মহাবল সিমেন্টকে বরাদ্দ করা হয়েছে তা স্পষ্ট করার নির্দেশ দেয়।
এরপর এপ্রিল মাসে DHAC একটি হলফনামা জমা দেয়। যেখানে বলা হয়, “৬ই মার্চ একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে গ্রাম থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে যাদের জমি নেওয়া হয়েছে তাঁদের পুনরায় অধিগ্রহণকৃত জমির সমান অনুপাতে জমি বরাদ্দ, এবং কৃষির জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।“
এর পরে মহাবল সিমেন্ট কোম্পানির তরফ থেকে আদালতে জমা পড়া আবেদনগুলি একত্রিত করে, চলতি বছরের ১২ই আগস্ট যৌথ শুনানি হয়। যার পর থেকেই আসামের এই জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি সারা দেশের নজর আকৃষ্ট করে।
বিচারপতি সঞ্জয় কুমার মেধির বেঞ্চ ১২ই আগস্ট, দাখিল হওয়া দুটি পিটিশনের শুনানি পুনরায় শুরু করেন। দুটি পিটিশনের মধ্যে একটি করা হয়েছে ২২ জন গ্রামবাসীর তরফ থেকে রাজ্য সরকার এবং সিমেন্ট কোম্পানি সহ আরও ৫ জনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, মহাবল সিমেন্ট কোম্পানির তরফ থেকে একটি পিটিশন দাখিল করা হয় রাজ্য সরকার সহ আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে।
শুনানির শুরুতেই মহাবল সিমেন্ট কোম্পানির আইনজীবী শ্রীমতি গোস্বামী উল্লেখ করেন যে বরাদ্দকৃত জমির আকার ৩,০০০ বিঘা।
যা শুনে বিচারপতি অবাক হয়ে একবার নয়, চারবার জিজ্ঞাসা করেন, “৩,০০০ বিঘা!… কী হচ্ছেটা কি? ৩,০০০ বিঘা জমি একটি বেসরকারি কোম্পানিকে বরাদ্দ করা হয়েছে?… এটা কী ধরণের সিদ্ধান্ত? এটা কি এক ধরণের রসিকতা নাকি অন্য কিছু?” এমনকি শুনানির সময়ে তিনি বরাদ্দকৃত জমির আকারকে “অসাধারণ” বলে উল্লেখ করেছেন।
এরপর এটিকে যখন প্রয়োজন রয়েছে বলে ব্যাখ্যা করেন আইনজীবী গোস্বামী, তখন বিচারপতি জানান, এটা প্রয়োজন কিনা সেটা সমস্যা নয়, মানুষের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে সেটা সমস্যা।
এরপর আদলত জানতে পারে, NAHC-র রাজস্ব বিভাগের অতিরিক্ত সচিব একটি অর্ডার জারি করেছে, যেখানে বলা হয়েছে – এই জমি বরাদ্দের উদ্দেশ্য হল একটি সিমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা।
এরপর আইনজীবী গোস্বামী কিছু রিপোর্ট দাখিল করে জানান, যে একটি টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাইনিংয়ের জন্য ওই জায়গা লিজ হিসাবে বরাদ্দ করা হয়েছে।”
এরপর আদালত NAHC-র আইনজীবী শ্রী সি. শর্মাকে, একটি কারখানার উদ্দেশ্যে ৩০০০ বিঘার মতো এত বিশাল পরিমাণের জমি বরাদ্দ করার নীতি সহ রেকর্ডগুলি জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি আদালত জানায়, “ভারতের সংবিধানের অধীনস্থ ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্গত ওই জেলায় বসবাসকারী উপজাতিদের অধিকার এবং স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।“
জল গড়াবে কোনদিকে? তা জানা যাবে আগামী শুনানিতে।
কেন এই জমি নিয়ে এত বিবাদ?
৩০০০ বিঘা জমি। জমির পরিমাণ এতটাই বেশি যা স্বাভাবিকভাবেই বিবাদ তৈরি করে। তবে, পরিমাণটাই একমাত্র সমস্যা নয়। এর পিছনে রয়েছে আরও বেশ কিছু কারণ।
১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল জেলা দিমা হাসাও, অসমের একটি আদিবাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ পাহাড়ি জেলা, যা উত্তর কাছাড় পাহাড় স্বায়ত্তশাসিত পরিষদ (NCHAC) দ্বারা পরিচালিত হয়।
সংবিধানের ২৪৪ অনুচ্ছেদের ২ ধারা এবং ২৭৫ অনুচ্ছেদের ১ ধারা অনুযায়ী সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল আমাদের দেশের ৪টি রাজ্যে আদিবাসীদের জমি সুরক্ষা দেয়। অসম, মেঘালয় ত্রিপুরা মিজোরাম।
সেই তফসিল অনুযায়ী দিমা হাসাওয়ের সমস্ত আধিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার, সংস্কৃতি, এবং স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই জমি অধিগ্রহণ সেই অধিকার খুন্ন করছে, পাশাপাশি পরিবেশগত ভাবেও এই জমির লিজ প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া সংবিধানের পঞ্চম তফসিল অনুযায়ী, PESA আইন ১৯৯৬ যা ২৪৪ অনুচ্ছেদের ধারা ১ এই জমিকে আরও সুরক্ষা প্রদান করেছে। সেই আইন বলছে, আদিবাসী জমি কোনওভাবেই বহিরাগত এবং ব্যাক্তিগত কোম্পানিকে দেওয়া যাবে না।
অর্থাৎ, অসম সরকার ইতিমধ্যেই সংবিধানবিরোধী কার্যকলাপ করে ফেলেছে।
আধিবাসীদের দাবি, এই জমির কেনাবেচা ষষ্ঠ তফসিল এবং আধিবাসী অধিকারের বিপরীতে। এই জমি তাঁদের পূর্বপুরুষদের। তাঁদের দাবি এই ঘটনায় প্রায় ১৪,০০০ গরীব পরিবার বেঘর হয়েছে।
জমি মামলায় এগিয়ে আদিবাসীরাই!
এর আগে ১৯৯৭ সালে সামাথা বনাম অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, তফসিল এলাকভুক্ত জমিকে কোনওভাবেই অ-অধিবাসী বা ব্যাক্তিগত কোম্পানিকে মাইনিং অথবা শিল্পের জন্য দেওয়া যাবে না। সেই অনুযায়ী, অসমের এই জমিও দেওয়া যায় না।
তবে, অসম সরকারের দাবী, ব্যাক্তিগত সংস্থাকে জমি দিলে রাজ্যের আর্থিক উন্নয়ন এবং শিল্পকরণ হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান।
কিন্তু বিরোধীদের দাবী, অসমের বিজেপি সরকার শুধু কর্পোরেট সংস্থার লাভ দেখছে।
এর মাঝে বিরোধীরা এই জমি কেনার পিছনে আদানির ভূমিকা রয়েছে বলে একাধিক খবর রটাতে থাকে। আদেও কি তা সত্য?
কিন্তু, তথ্য বলছে অন্য কথা। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে Mahabal Cement Private Limited-কে JK Lakshmi Cement (JK Group) অধিগ্রহণ করেছে। অর্থাৎ কোম্পানির মালিকানা বর্তমানে JK গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। এবং এই JK Group-এর সঙ্গে আদানি গ্রুপের কোনও লিঙ্ক নেই।
এমনকি বিরোধী নেতাদের তরফ থেকে বিভিন্ন তথ্য উঠে আসার পরেই ১৮ই আগস্ট গৌতম আদানি একটি প্রেস রিলিজ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি এই কোম্পানির সাথে তাঁর যোগাযোগের সমস্ত দাবি খণ্ডন করে, বিরোধীদের দাবির প্রমাণ চান।

এই ঘটনাটি শুধু জমি বিক্রির নয়। এটা একটি পরিবেশগত সংকট, আদিবাসী অধিকারের প্রশ্ন, আর প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব। এই লড়াই শিল্প উন্নয়ন বনাম আদিবাসীদের ভূমি অধিকার সুরক্ষার। আপনার কি মনে হয় এই জমি কি উন্নয়নের জন্য প্রাইভেট কোম্পানিকে দেওয়া উচিত? নাকি ছেড়ে দেওয়া উচিত অদিবাসীদের হাতেই? জানাতে ভুলবেন না কমেন্ট বক্সে।