কোটা, এই একটি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করে বাংলাদেশে জ্বলে ওঠে হিংসার আগুন। সরকারের সাথে জনগণের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে, চলতে থাকে খুনোখুনি ও মৃত্যুর তাণ্ডব। সেই আগুনের শিখা পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেও। আর এরপরেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে, দেশছাড়া হন শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)।
কিন্তু আদতে কোন শক্তির কারণে শুরু হল এই দ্বন্দ? প্রধানমন্ত্রী ছাড়াই কীভাবে চলছে বর্তমান বাংলাদেশ? শেখ হাসিনা কি আদেও ফিরতে পারবেন? আজ India Hood ডিকোড-এ এমন কিছু তথ্য খোলসা করবে আমরা, যা মাথা ঘুরিয়ে দেবে অনেকের।
দ্বন্দটা শুরু থেকেই?
সালটা ১৯৭১। শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে ভারত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। স্বাধীন হয় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা।
এরপর সালটা ১৯৭২। শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার মাধ্যমে শুধুমাত্র মুক্তি যোদ্ধাদের জন্য সরকারি চকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করেন।
এরপর ১৯৯৬, দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই কোটার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ছেলে-মেয়েদের। আর ঠিক ১৪ বছর পর, অর্থাৎ ২০১০ সালে ওই কোটার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নাতি-নাতনিদের। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে দারিদ্রতা একটি বিশাল আকার ধারণ করে, তার ওপর শিল্প ও অন্যান্য খাতে চাকরির অবস্থাও তেমন একটা ছিল না। এরপর কোটা ব্যবস্থার এমন প্রস্তাবনায় রেগে যায় দেশের অধিকাংশ মানুষ।
এরপর সালটা ২০১৮। কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্রমশ চাপ বাড়তে থাকায়, একপ্রকার বাধ্য হয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। শুধুমাত্র শিক্ষা ক্ষেত্র ছাড়া দেশের সমস্ত জায়গা থেকে মুক্তিবাহিনীর পরিবারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটার সংরক্ষণ সরিয়ে দেন।
এরপর ২০২৪ সালের জুন মাস। বাংলাদেশের হাইকোর্ট, ২০১৮ সালে যে কোটা সিস্টেম সরানো হয়েছিল, তা অসাংবিধানিক এবং বেআইনি দাবী করে পুনরায় ফিরিয়ে আনার রায় দেয়।
এই রায় নিয়ে পরে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন কিছু আইনজীবী ও শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্র নেতা নাহিদ ইসলাম, আবু বাকর মজুমদার এবং আসিফ মাহমুদ-এর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয় প্রতিবাদ।
এরপর ২০২৪ সালের ২৭শে জুলাই। সুপ্রিম কোর্টের তরফ থেকে রায় দেওয়া হয় যে, কোটা সিস্টেম তুলে দিয়ে শুধুমাত্র ৫ শতাংশ কোটা মঞ্জুর করা হবে। কিন্তু এরপরেও চলতে থাকে প্রতিবাদ। বাড়তে থাকে জনতার রোষ, চরমে ওঠে সরকারের সাথে বিরোধিতা। সরকার কড়া হাতে এই প্রতিবাদ দমন করতে গেলে মৃত্যু হয় বহু ছাত্র সহ একাধিক সাধারণ মানুষের। অন্যদিকে উত্তেজিত জনতা মারমুখী হয়ে ওঠে। প্রচুর সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করার পাশাপাশি ভাঙা হয় শেখ মুজিবর রহমানের মূর্তি। ভাঙচুর চালানো হয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেও। অবশেষে পদত্যাগ করে, দেশছাড়া হন শেখ হাসিনা।
এতদূর পর্যন্ত ঘটনাটা কোটা বিরোধী মনে হলেও, আমরা এবার এমন কিছু তথ্য তুলে ধরবো যা পাল্টে দেবে আপনার সম্পূর্ণ ধারণা।
ঘটনাটা ২০০৬ সালের। হঠাৎ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল জয়ী মহম্মদ ইউনুস-এর দুটি ডকুমেন্ট ফাঁস হয়।
একটি ডকুমেন্টে তিনি বলছেন, “দেশের দুই মেয়েকে রাজনীতি থেকে বের করা উচিত, অর্থাৎ শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া।“ এবং তিনি দেশ শাসনের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী দ্বারা দেশ শাসনের বিকল্প বেছে নেন, এবং তার প্রসংশা করেন।
অন্য ডকুমেন্ট অনুযায়ী, আমেরিকার বাংলাদেশ অ্যাম্বাস্যাডর জেমস মরিয়ার্টি, ইউনুসকে আস্বস্ত করে বলেন, আমি শেখ হাসিনার সাথে কথা বলে সব ঠিক করে দেবো।
এই ডকুমেন্ট সামনে আসতেই তোলপাড় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রাজ্য রাজনীতি, রেগে ওঠেন শেখ হাসিনা।
ওই একই সময়ে ভারতের বাংলাদেশের বিদেশ সচিবের জয়েন্ট সেক্রেটারি মোহন কুমার একজন আমেরিকান ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, ইউনুসকে নোবেল দিয়ে আমেরিকা বাংলাদেশের জনগণের কাছে ইউনুসের কৃতিত্ব এবং জনপ্রিয়তা তুলে ধরে তাঁকে সরকারে আনতে চাইছে, এবং তাঁকে দিয়ে নিজের অধিকার স্থাপন করে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করার চেষ্টা করছে। পর পর এমন বিভিন্ন ঘটনার পর শেখ হাসিনা, ইউনুসকে জেলে পাঠায় এবং গ্রামীণ ব্যাঙ্কের সমস্ত পদ থেকে তাঁকে অপসারণ করে।
কিন্তু এর পরে, বাংলাদেশের তৎকালিন সময়ে চলা পদ্মা ব্রিজের কাজের জন্য আমেরিকা থেকে আসা ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়াও, একাধিক প্রশ্ন উঠছে, যার উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কোটা সিস্টেম নিয়ে ২০২৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও, দেশের মানুষের মধ্যে রাগ কমল না কেন, কিংবা প্রতিবাদ থামল না কেন? কী কারণ?
দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদের প্রবল দাবীদার হওয়া সত্ত্বেও কেন খালেদা জিয়ার পরিবর্তে দেশের শাসন ব্যবস্থায় এলেন সেই মহম্মদ ইউনুস? উত্তর অধরা।
তৃতীয়ত, বর্তমানে সমস্ত দেশের ওপর শুল্ক চাপ জারি থাকলেও, বাংলাদেশের ওপর থেকেই হঠাৎ করেই শুল্ক হার কমিয়ে নেয় আমেরিকা। যার উত্তর স্পষ্ট নয়। কিন্তু ইঙ্গিত স্পষ্ট বলে মনে করছেন অনেকেই।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পরেই, ৮ই আগস্ট চিফ অ্যাডভাইসার হিসাবে প্রশাসনের ভার পান নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুস।
এরপর বাংলাদেশের রাজ্য প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনে বেশ কিছু সংস্কার করা হয়।
নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় জঙ্গী মদতকারী জামায়েত-এ-ইসলাম পার্টির ওপর থেকে।
নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী ও জনতারা সম্মিলিত হয়ে গঠন করেন নাগরিক পার্টি’।
ওই বছরের শেষের দিকে, ২৬শে ডিসেম্বর আগুন লাগে ঢাকার সচিবালয়ে। জানা যায়, ওই আগুন লাগার ফলে পুড়ে গিয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তবে এটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতার ছক, সেই উত্তর এখনও অধরা।
এরপর সালটা ২০২৫। হঠাৎ করে, হাসিনা পন্থীদের বলা ভালো আওয়ামী লীগ পন্থীদের বিরুদ্ধে চালানো হয় অপারেশন ডেভিল হান্ট। ৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করা ওই অপারেশন এখনও চলছে। এই অপারেশনের সময়কালে আটক করা হয় বারো হাজারের বেশি মানুষকে। এই সময়কালে বৃদ্ধি পায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। হিন্দুদের হত্যা করা হয়, তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ভেঙে দেওয়া হয় মন্দির।
চলতি বছরের ১০ মে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ এবং এর নেতাদের বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ওই দলের যাবতীয় কার্যক্রম নিষেধ করা হবে। ওই ট্রাইব্যুনাল, শেখ হাসিনাকে আদালত অবমাননার অভিযোগে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও। অনেকেই অনুমান করছেন হয়তো এগিয়ে আনা হবে দেশের নির্বাচন।
বর্তমানে, বাংলাদেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকলেও, উল্লেখযোগ্যভাবে উঠে আসছে পাঁচটি দলের নাম।
- বিএনপি অর্থাৎ বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি – বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি এই দলের সভাপতি তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া।
- জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি।
- রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ।
- নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি।
- শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়েতে ইসলামি।
শেখ হাসিনা কী ফিরতে পারবেন?
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোন রাজনৈতিক দল দেশের সরকার গঠন করবে, তা বলা মুশকিল হলেও এটা বলা সহজ যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ফিরছে না।
কারণ প্রথমত, আওয়ামী লীগ বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার অধীনে আছে, যার ফলে সেই দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা অন্য দলের হয়ে নির্বাচনে লড়তেই পারেন, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে বিনাশ্রম কারাদণ্ডের সাজা সহ একাধিক অপরাধের চার্জ রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন প্রার্থী যদি মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি বা গুরুতর অপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত হন, তবে তিনি নির্বাচনে লড়তে পারেন না।
তৃতীয়ত, একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তবেও তারা হাসিনাকে প্রার্থী নাও করতে পারেন। কারণ দলের একাংশ শেখ হাসিনার পক্ষে থাকলেও, অনেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের পক্ষে।
চতুর্থত, আমরা আগেই আমেরিকার হস্তক্ষেপের যে কথা বলেছি সেটাই একটি কারণ হাসিনার না ফেরার। কারণ, জাতিসংঘ, থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিরোধী।
তাই, এক বাক্যে বলা যায়, আইনগতভাবে অযোগ্য, ও সংসদের সদস্য না হওয়ায় শেখ হাসিনা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। তবে, রাজনীতি মানেই পালাবদল, কিংবা নতুন ইতিহাস তৈরি। সবশেষে, নির্বাচনের আগে যদি সমস্ত মামলায় তিনি খালাস পান এবং দলীয় সমর্থন ফিরে পান, তাহলে ২০২৬ সালের নির্বাচনের পর পুনরায় প্রধানমন্ত্রীত্ব হওয়ার একটি সীমিত সম্ভাবনা থেকে যায়।