India Hood Decode: E20 পেট্রোলে লাভ হবে বেশি নাকি ক্ষতি?

E20 Petrol
E20 Petrol

পেট্রোল, ডিজেল অতীত, এবার গাড়ির দুনিয়ায় রাজত্ব করতে হাজির E20 পেট্রোল (E20 Petrol)। ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানির পর এবার ভারতেও আছড়ে পড়েছে E20 পেট্রোলের ট্রেন্ড। আর এই E20 পেট্রোল নিয়ে এখন হাঙ্গামা সারা দেশ জুড়ে!

একদিকে সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যাচ্ছে গাড়ির মাইলেজ কমা ও খারাপ হওয়ার অভিযোগে। সেখানেই অন্যদিকে, এই সমস্ত অভিযোগকে “পেট্রোল লবি” আখ্যা দিয়ে, জোর কদমে E20-র প্রচার চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার!

বিশ্বের একাধিক দেশে যেখানে E20 চালাচ্ছে গাড়ি, সেখানে আমাদের দেশে এই ফুয়েল গাড়ির জন্য ক্ষতিকর – এমন দাবি উঠছে কেন? নাকি এক্ষেত্রেও গুজব ছড়াচ্ছেন বিরোধীরা?

কী এই E20 পেট্রোল? এটি ব্যবহার করলে আদেও কোনও লাভ হবে, নাকি ক্ষতি? আজ এক এক করে সমস্ত তথ্য ডিকোড করবে India Hood।

২০২৩ সালের ৬ই মার্চ, ব্যাঙ্গালোরে ‘ইন্ডিয়া এনার্জি উইক’ অনুষ্ঠানে ১১টি রাজ্যে E20 পেট্রোলের পাইলট প্রকল্প চালু করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পেট্রোলের দাম কমাতে এবং গাড়ির কর্মক্ষমতা বাড়াতে E10-এর পরিবর্তে E20 পেট্রোল চালু করার লক্ষ্য নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। আর এই সময়সীমা রাখা হয় ২০৩০। কিন্তু ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে, নির্ধারিত সময়সীমার ৫ বছর আগেই সেই লক্ষ্যে সফল হয় কেন্দ্রীয় সরকার।

কী এই E20 পেট্রোল? | E20 Petrol

E-এর অর্থ ইথালন, আর পেট্রোল আমরা সকলেই জানি। যখন পেট্রোলে 20% ইথালন মেশানো হয়, তখন সেই পেট্রোলের নাম হয় E20 পেট্রোল। আর যখন পেট্রোলে 10% ইথালন মেশানো হয়, তখন সেটি হয় E10 পেট্রোল। বর্তমানে আমরা যে পেট্রোল ব্যবহার করি তার অধিকাংশই E10 পেট্রোল।

এবার অনেকেই ভাবতে পারেন ইথানল আবার কি? ইথানল একধরনের বায়োফুয়েল অর্থাৎ জৈব জ্বালানি, যার বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা C₂H₅OH। এটি তৈরি হয় আখ, ভুট্টা, গুড়, গম, ভাঙা ধান এবং অন্যান্য জৈব উপাদান থেকে।

ইথানল পেট্রোল একধরনের Renewable Energy, কারণ ইথানল তৈরি হয় উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া থেকে।

একদিকে গাড়িতে E20 পেট্রোল ব্যবহারের পর যে কার্বন নির্গমন হচ্ছে, সেটাই আবার গাছের সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হচ্ছে। আবার সেখান থেকেই ইথানল তৈরি হচ্ছে। তাই এটি Renewable Energy।

একদিকে গাছ চাষ করে যত খুশি ইথানল সংগ্রহ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ক্রুড অয়েল অর্থাৎ পেট্রোল-ডিজেল তৈরি হতে সময় লাগে কয়েক লক্ষ বছর। শুধু তাই নয়, ইথানল পোড়ার ফলে E10 পেট্রোলের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ হয়।

ভারতে ইথানলের ইতিহাস

২০১৪ সালের আগে, যখন ক্ষমতায় আসেনি মোদী সরকার, তখন পেট্রোলের সাথে মেশানো হত ১.৫ শতাংশ ইথানল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশেও বাড়তে থাকে তেলের দাম। বিরোধীদের বিরোধিতা বাড়তে থাকে তেলের দামের মতোই। তাই তেলের দাম কমাতে, গাড়ির কর্মক্ষমতা বাড়াতে, এবং কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর লক্ষ্যে পেট্রোলের সঙ্গে ইথানল মিশিয়ে ‘ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল (EBP)’ প্রকল্প চালু করা হয়। ২০২৩ সাল অবধি পেট্রোলে ইথানল মেশানোর পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশ।

ইথানলের সুবিধা

প্রথমত, এই তেল নবীকরণযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব। E10 পেট্রোল ব্যবহারের ফলে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমেছে ২৭ লাখ টনেরও বেশি। তাহলে E20 পেট্রোল ব্যবহার করলে এই নির্গমন আরও কমবে। ফলে বায়ুদূষণ কমবে।

দ্বিতীয়ত, কৃষকদের লাভ বাড়বে। উপকার হবে আখ উৎপাদনকারী কৃষকদের। আখ ছাড়াও ভাঙা ধান, ভুট্টা, ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য থেকে ইথানল আহরণ করা যায়, ফলে ৪০,০০০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারবেন সারা দেশের কৃষকরা। এই চাষের জন্য সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সুবিধাও দেওয়া হবে।

তৃতীয়ত, সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, কেন্দ্র সরকার ইতিমধ্যেই ১০ শতাংশ ইথানল মিশ্রিত পেট্রোল বিক্রি করে ৪৩,০০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করেছে। ফলত E20 পেট্রোল ব্যবহার করা হলে, লক্ষ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে দেশের।

চতুর্থত, কমবে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা এবং আমদানি খরচ। যানবাহনের জ্বালানির চাহিদার প্রায় ৯৮% বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানি দ্বারা এবং বাকি ২% জৈব জ্বালানি দ্বারা পূরণ করা হয়। E20 পেট্রোল ব্যবহারের ফলে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বাড়বে, আমদানি করা তেলের পরিমাণ কমবে, কমবে খরচও।

পঞ্চমত, বাড়বে মাইলেজ ও পারফরম্যান্স। হিরো মোটরকর্প অনুযায়ী, ইথানলের অকটেন রেটিং পেট্রোলের চেয়ে বেশি, তাই E20 জ্বালানির জন্য ডিজাইন করা ইঞ্জিনগুলিকে উচ্চতর কমপ্রেশন অনুপাতের সাথে টিউন করা যেতে পারে, যা বাইকের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও মাইলেজ বাড়ায়।

গবেষণার রিপোর্ট কি বলছে?

২০১৪-১৫ সালে ইথানল মিশ্রিত পেট্রোল নিয়ে ARAI, IIP এবং ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন যৌথভাবে এক গবেষণা চালায়, যেখানে উঠে আসে ইথানল পেট্রোল ব্যবহার করলে ৬ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি সাশ্রয় হতে পারে। ঠান্ডা ও গরম আবহাওয়ায় গাড়ি স্টার্ট করতে কোনও অসুবিধা হয় না। পারফরম্যান্সও ভালো থাকে। গাড়ি চলাকালীন কোনও বড়সড় যান্ত্রিক সমস্যা বা ত্রুটি দেখা যায় না। ইঞ্জিনও ঠিক থাকে। ময়লা জমে না, তেলের গুণগত মানও নষ্ট হয় না।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং Honda R&D-র গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যদি ইঞ্জিন E20 ব্যবহারের জন্য সঠিকভাবে টিউন করা হয়, তাহলে এটি স্বাভাবিক পেট্রোলের তুলনায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত মাইলেজ বাড়াবে।

Ford Motor Company-র গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে E20 জ্বালানির জন্য উপযুক্ত ইঞ্জিন সাধারণ পেট্রোলের মতোই মাইলেজ ও পারফরম্যান্স দিতে পারে, পাশাপাশি কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।

বিভিন্ন অভিযোগঃ

এক্স হ্যান্ডলে প্রমোদ যোশী নামের একজন ব্যক্তি একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে তার ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘E20 পেট্রোল ব্যবহারের পর থেকে ভক্সওয়াগন ভেন্টোর মাইলেজ হঠাৎ করে কমে ১০ কিমি প্রতি লিটার থেকে ৬ কিমি প্রতি লিটার হয়েছে।

এক্স হ্যান্ডলে আরেক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোনও দেশে নন-কমপ্ল্যায়েন্ট বা ই-১০ কমপ্ল্যায়েন্ট গাড়িতে জোর করে ই-২০ পেট্রোল ব্যবহার করছে না। ই২০ পেট্রোল মাইলেজ কমিয়ে দেয় এবং ইঞ্জিনের ক্ষতি করতে পারে যা শেষ পর্যন্ত গাড়ির আয়ু কমিয়ে দেয়।

কেউ কেউ বলছেন এই তেল গাড়ির কিছু অংশের ক্ষতি করতে পারে, যেমন ফুয়েল ইনজেক্টর, থ্রটল বডির মতো যন্ত্রে দেখা দিতে পারে সমস্যা।

TV9-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইথানলের এনার্জি ডেনসিটি পেট্রোলের তুলনায় কম। ফলে বেশি ইথানল মিশ্রিত পেট্রোলের এনার্জি ডেনসিটিও অনেকটাই কমে যাবে। আর সেই কারণেই একই দূরত্ব যেতে কিছুটা বেশি তেল প্রয়োজন হবে।

ARAI রিপোর্ট অনুযায়ী, পুরানো গাড়িতে ১ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে কমবে গাড়ির মাইলেজ। বেশ কিছু গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা বলছে মাইলেজ কমবে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।  যদিও অনেক গাড়ির মালিক বলছেন মাইলেজ কমেছে ২০ শতাংশের কাছাকাছি।

সরকারের যুক্তি

২০২৫ সালের ১২ই আগস্ট, বিজনেস টুডে-র এক সামিটে সড়ক ও পরিবহনমন্ত্রী নীতিন গদকরি সোশ্যাল মিডিয়ার একাধিক অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জানান, এই সমস্ত অভিযোগের কোন যুক্তি নেই। পাশাপাশি তিনি চ্যালেঞ্জ করে জানান, “আমাকে সারা বিশ্বের এমন একটি গাড়ি দেখান যেখানে E20 পেট্রোলের কারণে সমস্যা হয়েছে! E20-তে কোনও সমস্যা নেই।” তিনি আরও ব্যাখ্যা করে জানান, যে গাড়ির মাইলেজ জ্বালানির ধরণ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়, যেমন গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, টায়ারের হাওয়া, রাস্তার ধরন, এবং এয়ার কন্ডিশনিং লোড। তিনি আরও জানান, বেশ কিছু E10 গাড়িতে E20 পেট্রোল ব্যবহারের ফলে গাড়ির মাইলেজ সামান্য হ্রাস পেয়েছে। তবে বেশ কিছু নির্মাতারা ২০০৯ সাল থেকেই E20 সামঞ্জস্যপূর্ণ যানবাহন নির্মাণ করছে। ফলে সেই সমস্ত যানবাহনে মাইলেজ কমার প্রশ্নই ওঠে না।” তবে, পুরানো কিছু গাড়ির ক্ষেত্রে রবারের যন্ত্রাংশ এবং গ্যাসকেট পরিবর্তন করতে হতে পারে। পাশাপাশি, এমন কিছু অভিযোগে বলা হচ্ছে, “E20 জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বীমা কোম্পানিগুলি গাড়ির ক্ষতি পূরণ দেবে না।“ এই অভিযোগ তিনি খণ্ডন করে দিয়ে জানান, “বীমা সম্পর্কিত এই সমস্ত টুইট গাড়ির মালিকদের মনে ভয় ও বিভ্রান্তি তৈরির জন্য করা হচ্ছে।

কত টাকা দাম হতে পারে?

E20 পেট্রোলে ৮০ শতাংশ পেট্রোল এবং ২০ শতাংশ ইথানল ব্যবহার করা হয়। কলকাতায় লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম বর্তমানে ১০৫টাকা ৪১ পয়সা, এর ৮০ শতাংশ পেট্রোলের দাম হবে ৮৪ টাকা।

অন্যদিকে ইথানলের দাম লিটার প্রতি প্রায় ৫৫ টাকা। এক্ষেত্রে ২০ শতাংশ ইথানলের দাম হবে ১১ টাকা।

এক্ষেত্রে, এক লিটার E20 পেট্রোলের দাম আনুমানিক ৯৫ থেকে ১০০ টাকার কাছাকাছি হতে পারে।

কোন কোন কোম্পানি E20 পেট্রোল দেয় আমাদের দেশে?

আমাদের দেশের সমস্ত তেল সংস্থা বর্তমানে E-20 পেট্রোল প্রদান করে। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, হিন্দুস্তান পেট্রলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড, ভারত পেট্রলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড সহ জিও এবং ব্রিটিশ পেট্রলিয়াম যৌথভাবে আমাদের দেশের প্রায় ২০০০টিরও বেশি পাম্পে এই তেল প্রদান করে।

কোন কোন দেশে রাজ করছে E20?

ব্রাজিলে বর্তমানে E27 পেট্রোলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের ফ্রান্স, সুইডেন, জার্মানি ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ড – এখানে E20 বা তার থেকেও বেশি ইথানল মিশ্রিত জ্বালানি ব্যবহার হচ্ছে। এবং সেখানকার দেশে E20–E85 ফ্লেক্স ফুয়েল ব্যবহার করতে সক্ষম। আবার সেই সমস্ত দেশে ফ্লেক্স ফুয়েল পাম্পিং স্টেশনে E20–E85 পাওয়া যায়।

এছাড়াও, বেশ কিছু দেশে জোর কদমে চলছে E20 চালু করার পরিকল্পনা, যার মধ্যে রয়েছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন্স এবং কানাডার মতো বিভিন্ন দেশ।

এটা পরিষ্কার E20 পেট্রোলই ভবিষ্যৎ। এবং এটি ব্যবহার করলে পরিবেশ দূষণ যেমন কমবে, বাড়বে গাড়ির পারফরম্যান্স এবং মাইলেজও। তবে, একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, এই লক্ষ্যে সফল হতে গেলে সবার আগে গাড়িগুলিকে E20 পেট্রোলের জন্য টিউনিং করতে হবে। Hero Motocorp জানিয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের সমস্ত গাড়ি E20 সামঞ্জস্য করা হবে।

E20 পেট্রোল নিয়ে আপনাদের কি মতামত? আপনারা কি এখনও পর্যন্ত এই তেল ব্যবহার করে কোন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন? জানাতে ভুলবেন না কমেন্ট বক্সে।

Leave a Comment