জীবনের আরেক নাম লড়াই ও অধ্যবসায়। বেঁচে থাকতে হলে প্রত্যেককে লক্ষ্য স্থির রেখে লড়ে যেতে হয় প্রতিটা মুহূর্তে। তবে কারো ক্ষেত্রে লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া সহজ হয়, কারো ক্ষেত্রে হয় অত্যন্ত কঠিন। তবে কঠিন অধ্যবসায় চালিয়ে যাওয়ার পর যাঁরা সফলতার সিঁড়ি ছুঁতে পারেন, তাঁদের গল্পগুলো থেকে যায় অমর হয়ে। ভারতীয় সেনা জওয়ান হোকাতো সেমার জীবন ঠিক তেমনই এক অনুপ্রেরণামূলক গল্প।
ভারতের এই বীর সৈনিক এক সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিজের পা হারান। জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেননি তিনি। নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে কঠিন অধ্যবসায় ও অদম্য লড়াইয়ের মাধ্যমে ২০২৪ সালের প্যারিস প্যারাঅলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ পদক জিতে পুরো বিশ্বের সামনে নিজের যোগ্যতা ও সাহসিকতার উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তাই এই বীর সৈনিকের গল্পটা আপনারও জানা দরকার।
জঙ্গি হামলার পরেই শুরু সেমা’র জীবনসংগ্রাম
হোকাতো সেমা ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্য থেকে উঠে এসেছেন। ছোট থেকেই ভারতীয় সেনা হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। একজন সদস্য ছিলেন। ২০০২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের এক সেনা ছাউনিতে ছিলেন তিনি। সেখানেই হামলা চালায় জঙ্গিরা। পাল্টা জবাব দেয় সেনারাও। কিন্তু এর মাঝে পরিখায় এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হলেন সেমা। একটি পা হারাতে হয় তাঁকে। তবে শারীরিক ক্ষতি হলেও, এই হামলা মানসিকভাবে তাঁকে দমাতে পারেনি। বরং এটি তাঁকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার অদম্য ইচ্ছাশক্তি
হামলার পর, হোকাতো সেমা শারীরিকভাবে অক্ষম হলেও, তাঁর মানসিক শক্তি অবিচল ছিল। রিহ্যাব করতে করতে তিনি প্যারাঅলিম্পিক্সে অংশ নেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হন। শুরুতে এই জার্নিটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু সেমা তাঁর লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। বিশেষজ্ঞ ক্রীড়া প্রশিক্ষকদের সাহায্যে তিনি প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর প্রশিক্ষণ নিতেন। প্রোস্থেটিক পা ব্যবহার করে নতুন করে হাঁটা শেখা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হওয়া—প্রতিটি ধাপে তাঁর ছিল অদম্য মানসিকতা। তাঁর কঠোর পরিশ্রম এবং ইচ্ছাশক্তিই তাঁকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে।
২০২৪ প্যারিস প্যারা অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ পদক জয়
সেমার অসামান্য অধ্যবসায় এবং সাহসী মনোবল তাঁকে ২০২৪ প্যারিস প্যারাঅলিম্পিক্সে নিয়ে আসে। তিনি অংশ নিয়েছিলেন প্যারা অ্যাথলেটিক্সের F57 ক্যাটাগরিতে। এই ইভেন্টে তিনি নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। তাঁর এই অর্জন শুধু একটি পদক জয়ের ঘটনা নয়, এটি তাঁর জীবনের লড়াই, সংকল্প এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখনো ভারতীয় সেনায় কর্মরত সেমা
এখনো ভারতীয় সেনার হয়ে কাজ করছেন সেমা। অলিম্পিক পদক জয়ের পরেও সেই সুযোগ তাঁর কাছে থাকবে। কারণ বর্তমানে তিনি ভারতীয় সেনার অসম রেজিমেন্টে হাবিলদার পদে রয়েছেন।এককথায়, হোকাতো সেমার জীবন শুধুমাত্র ভারতের জন্য নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্যই একটি বিরল উদাহরণ। তিনি প্রমাণ করেছেন যে শারীরিক সীমাবদ্ধতা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়, যদি মানসিক শক্তি এবং সংকল্প দৃঢ় থাকে। তাঁর জীবনের এই অধ্যায় আমাদের শেখায় যে, কঠিন সময় এলেও মনোবল এবং ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সব কিছু জয় করা সম্ভব।