India Hood Decode: কেন সম্পন্ন হয়নি ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান, কে দায়ী, কী বলছে ইতিহাস?

Ghatal Masterplan
Ghatal Masterplan

ভোট আসে ভোট যায়, বর্ষা আসে বর্ষা যায়, কিন্তু ঘাটাল থেকে যায় ঘাটালেই। হালকা বৃষ্টি হলেই রাস্তায় গাড়ির বদলে চলে নৌকা। বছরের পর বছর পেরোলেও কেন পূর্ণতা পাচ্ছে না ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান (Ghatal Masterplan)? ভোটের পর ভোট জিতলেও, কেন এখনও ঘাটালের কোন সুরাহা করতে পারছেন না সাংসদ দেব? ১৯৫২ সাল থেকে দশকের পর দশক কেটে গেলেও, কেন কোন রাজনৈতিক দল মেটাতে পারেনি এই সমস্যা। এর পিছনে রয়েছে শুধুই কি রাজনৈতিক কারণ? নাকি অন্য কিছু? আজ সব কিছু ডিকোড করবে Indiahood।

বর্ষা ঢুকতেই, এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ফের জলের তলায় তলিয়ে গেল ঘাটাল। রাস্তা হোক বা চাষের জমি, কিংবা ঘরবাড়ি, সবই এখনও জলমগ্ন। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের জীবন। তবে, এই বন্যা কেবল ঘাটালেই হয়নি, হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন, সেখানকার সাংসদ দেবকে নিয়ে চলছে ট্রোলের বন্যা সোশ্যাল মিডিয়ায়।

তবে সমস্ত দায় কি শুধু দেবের ওপরেই বর্তায়? ঘাটালের ইতিহাস বলছে অন্য কিছু।

ইতিহাস কী বলছে…

সালটা ১৯৫২। স্বাধীনতার ৫ বছর পর, প্রথম ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে কেন্দ্রীয় সরকারের। তবে, এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নিতে লেগে যায় টানা ৭টা বছর। এরপর ঠিক ১৯৫৯ সালে, দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মান সিংয়ের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন, এবং ঘাটালের পরিস্থিতি পরিদর্শন করার নির্দেশ দেন। সেই মতো পরিদর্শনও হয়, রিপোর্ট জমাও দেয় মান সিং কমিটি। তবে, কোন অজানা কারণেই থেমে যায় প্রকল্পের কাজ।

ঠিক ৪৩ বছর পর ১৯৮৩ সালে, প্রথম শোনা যায় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান শব্দটি। প্রকল্পের শিলান্যাস করেন, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সেচ মন্ত্রী প্রভাস রায়। আদতে কী এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান? ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের মূল লক্ষ্য ঘাটালকে বন্যা পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করা এবং নদী এবং শাখানদীগুলির নদীবাঁধ মেরামত করে সেগুলির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানো এবং লক গেট বাসানো। এসবের পাশাপাশি পাম্প হাউস তৈরি, নদীপথ সংস্কার, স্থানীয় খালগুলির সংস্কার করে, সেগুলিতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা।

এরপর ১০টি বর্ষা পেরিয়ে ১৯৯৩ সাল, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান পুনরায় রূপায়ণ করার জন্য ঘাটালের বাসিন্দারা গঠন করেন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি। তবে ফলাফল সেই একই। কারণ হিসাবে রাজ্য ও কন্দ্রের তরজাকে দায়ী করেন একাংশ।

এরপর সালটা ২০০৭। ব্যাপক বন্যার সম্মুখীন হয় ঘাটালবাসী। নড়েচড়ে বসে রাজ্য সরকার। যার ফলে ২০০৯ সালে পুনয়ায় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যৌথ ভাবে এই উদ্যোগ নেয় ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার কনসাল্টেন্সি সার্ভিস এবং পশ্চিমবঙ্গের সেচ ও জলপথ বিভাগ। ওই বছরের ২৪শে আগস্ট ডিটেল্ড প্রোজেক্ট রিপোর্ট প্রস্তুত করেন তারা।

এরপর ২০১০ সালে, ওই ডিটেল্ড প্রোজেক্ট রিপোর্ট জমা দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনে। তবে কিছু তথ্য নিয়ে সংশয় থাকার কারণে, ২০১১ সালে ওই ডিটেল্ড প্রোজেক্ট রিপোর্ট ফেরত পাঠানো হয়। এই সময়ে প্রথম প্রকাশ্যে আসে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পের খরচ। জানা যায় প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পের জন্য প্রায় ২২০০ কোটি টাকার আবেদন করে রাজ্য সরকার। তবে ওই খরচের অনুমোদন নাকচ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।

কিন্তু, ওই রিপোর্টকে সম্পূর্ণ করে ফের পাঠাতে রাজ্য সরকারের লেগে যায় আরও দু’বছর।

এরপর আসে ২০১৩ সালে, খড়গপুর আইআইটি-কে দিয়ে সংশোধিত ডিটেল্ড প্রোজেক্ট রিপোর্ট প্রস্তুত করে, তা পুনরায় পাঠানো হয় কেন্দ্রের কাছে। এবার খরচ হিসাবে কেন্দ্রের কাছে জমা দেওয়া হয় ১২৪০ কোটি থেকে ১৪৯২ কোটি টাকার রিপোর্ট।

সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখে ২০১৫ সালে, গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন ওই প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। তবে, অর্থায়নের অনুপাত নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে দ্বন্দ চলায় আঁটকে যায় প্রকল্পের কাজ। প্রথমে, এই অর্থায়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের তরফ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং রাজ্যের তরফ থেকে ২৫ শতাংশ দেওয়ার কথা ছিল। পরে এই অর্থায়নের অনুপাত কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ের মধ্যে সমানভাবে অর্থাৎ ৫০ শতাংশ করে ভাগ হয়ে যায়।

এরপর ২০১৬ সালে পুনরায় কেন্দ্রীয় দফতরের তরফ থেকে পুনরায় ডিটেল্ড প্রোজেক্ট রিপোর্ট চাওয়া হলেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই।

২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নিজের খরচে রাজ্য সরকার প্রায় ৩৫০ কোটি  টাকা ব্যয় করে প্রথম ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য কাজ শুরু করে।

যার মধ্যে ৭৩ কোটি টাকা খরচ করে পলাশপাই খাল, ৮৬ কোটি টাকা খরচ করে দুর্বাচ খাল, আরও ৮৬ কোটি টাকা খরচ করে নিউ কোশী খাল, এবং ৬৩ কোটি টাকা খরচ করে খীরপাই-বকসি খাল খনন করা হয়। এর পাশাপাশি চন্দ্রেশ্বর খাল সহ ৫টি স্লুইস গেট, ২টি পাম্প হাউসের জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য সরকার।

এরপর ২০২৫ সালে রাজ্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য সরকার। পাশাপাশি ২০২৮ সালের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছে।

কিন্তু এত বছর পেরোলেও কেন সম্পন্ন হয়নি কাজ?

প্রথমত সক্রিয় পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই বিলম্ব হয় এই কাজে। যখন সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়, তখন দীর্ঘ সময় লেগে যায় রিপোর্ট তৈরিতে, আবার কখনও সময় লেগে যায় পর্যালোচনা করতে, আবার কখনও সময় লেগে যায় তা অনুমোদন করতে। যখন অনুমোদন পাওয়া যায়, তখন দেখা যায় আর্থিক টানাপোড়েন। রাজ্য কেন্দ্রের মতভেদ তো আছেই, সাথে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও স্থানীয় মানুষদের স্থানান্তরে জটিলতাও এই প্রকল্পের কাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একাধিকবার।

গত ৮০ বছরের বেশি সময় কেটে গিয়েছে, নজর পড়লেও গা করেনি কোন সরকারই। পরিবর্তনের হাওয়া দেশ তথা রাজ্য ঘুরলেও, ঘাটালের প্রতি যেন তার বরাবরের অনীহা। আদতে কবে ঘাটালমুখী হবে সেই হাওয়া? উত্তর জানা নেই আমাদের। আপনাদের কী মনে হয়?

Leave a Comment