সহেলি মিত্র, কলকাতাঃ সোহিনী গাঙ্গুলি (Sohini Ganguly)…যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তাঁরা এই সোহিনীর ভিডিও দেখে থাকবেন নিশ্চয়ই। বর্তমানে এই জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার শিরোনামে উঠে এসেছে। এর কারণ তাঁর সঙ্গে ঘটে গিয়েছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। প্রসবের আগেই মারা গিয়েছে তাঁর সন্তান। ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় হয়ে গিয়েছে। অন্তঃসত্ত্বাকালীন অবস্থায় প্রেগন্যান্সির প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করেছেন সোহিনী। মেটারনিটি শুট থেকে সাধভক্ষণের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো প্রত্যেকের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন সোহিনী। তবে এখন তাঁর কোলশূন্য। পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসকের গাফিলতিতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে পারেনি। এই ইস্যুতে এবার সেই চিকিৎসক মুখ খুললেন।
সোহিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের গর্ভের সন্তানের মৃত্যু ঘিরে নার্সিং হোম ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠেছে তাঁর আত্মীয় ও পরিবারের সদস্যদের উপর। এর পাশাপাশি ডাক্তার এস এন দাসের উপর চড়াও হয়েছে তাঁরা! ব্যাপারটি কী এক তরফা? সত্যিই কি হয়েছিল সোহিনী ও তাঁর সন্তানের সঙ্গে? এই নিয়ে মুখ খুললেন এস এন দাস।
ডাঃ এস এন দাস…তিনি একজন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ। কাচরাপাড়া বেল্টে গত ৩ বছর ধরে প্র্যাকটিস করছেন। ঘটনা প্রসঙ্গে এক ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, ‘গত শুক্রবার একটি ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, খুনি, নরপিশাচ বলা হচ্ছে। সবরকমভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। আমাকে মাতাল অবধি বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি তা স্মোকও করি না, মদও না। এই ঘটনার ফলে আমার রোগীরা যারা এতদিন ধরে আমাকে দেখাচ্ছেন, তাঁরা ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছেন। আমার পরিবারকেও ব্যাপকভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। সেজন্য আমার মনে হয় ঘটনাটা পুরো এক তরফা হয়ে যাচ্ছে এবং আমার এবার ক্ল্যারিফিকেশন করা দরকার। আমি গত ২২ আগস্ট সাত সকালে একটি ফোন পাই যার আমার আন্ডারেই ট্রিটমেন্ট চলছে। আমাকে বলা হয় যে তাঁর বাচ্চা রাত থেকে নড়ছে না। আমি তো পেসেন্টকে চিনি। তাঁর ব্লাড প্রেশার অনেকটা বেশি, তাঁর বাচ্চাটা ভীষণ ছোট। তাই তাঁকে বলে দেরি না করে আমার বাড়িতেই এসো।’
চিকিৎসক আরও জানান, ‘এরপর তাঁরা সকাল ৮টার সময়ে আমার বাড়িতে আসে। এরপর আমার বাড়িতে তাঁকে পরীক্ষা করে দেখি পেসেন্টের প্রেসার অনেকটা বেশি। বাচ্চা তখনও মাঝে মধ্যে নড়ছে। সেই সময়ে তাঁকে দ্রুত আমি হাসপাতালে ভর্তি হতে বলি। আল্ট্রাসাউন্ড করে ডায়গনোসিস করতে বলি। এই পেসেন্টের কিন্তু আগে থেকেই ব্লাড প্রেসার বেশি ছিল। প্রেসারের ওষুধের জন্য তাঁকে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট নিতে বলা হয়েছিল। এরপর পেসেন্টের পরিবার আমাকে পৌনে ১১টা নাগাদ ফোন করে জানায় যে আউটসোর্সে আল্ট্রাসাউন্ড করা হয়েছে এবং রিপোর্টে সব নরমাল আছে। আমি বলি তাহলে হাসপাতালে ভর্তি করে দিন পেসেন্টকে। তো ওনারা বললেন যে আমাকে একবার ওনারা দেখাতে চান পেসেন্টকে। আমি মিলিনিয়াম নার্সিংহোমে ছিলাম। সেখানে পেসেন্টকে সঙ্গে নিয়ে আসতে বললাম। পেসেন্টকে দেখি, এরপর সে জানায় যে আমার বাচ্চা নড়াচড়া করছে। আমি বলি তারপরেও আপনার অবসারভেশনে থাকতে হবে ফলে ভর্তি হয়ে যান। এরপর আমার নার্স, আরএমও ডাক্তাররা পরীক্ষা করে দেখেন বাচ্চার কোনও ফিটাল হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না। আমিও পরে পরীক্ষা করে দেখি যে সত্যিই বাচ্চার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না। এটা তাঁর হাসবেন্ডকে জানাই। আরও এক এক্সপার্টের সঙ্গে কনসাল্ট করা হয়, তিনিও জানান যে বাচ্চাটি আর নেই। এরপর সেই রিপোর্ট নার্সিংহোমে নিয়ে এসে ভাংচুর করেন, বিক্ষোভ দেখান। এরপর তাঁরা পেসেন্টকে ডিওআরবি করে নার্সিংহোম থেকে নিয়ে চলে যান।’
হেনস্থা প্রসঙ্গে এস এন দাস বলেন, ‘এরপর আমার কাঁচরাপাড়ার বাড়িতে এসে বেশ কিছু উত্তেজিত জনতা আমাকে হেনস্থা করে। ভার্বাল অ্যাবিউজ করেন। তাঁদের বক্তব্য, সিজারটা তখনই কেন করলেন না। বাচ্চাটি প্রিটার্ম ছিল, ওজনও অনেক কম ছিল। এই অবস্থায় বললেই তো আর সিজার করা যায় না। তারওপর আবার প্রিটার্ম বাচ্চা। বাচ্চার বাইরে এসেও অনেক সমস্যা হতে পারে। কিন্তু ভর্তির পর থেকে যেহেতু আমি ফিটাল হার্টসাউন্ড পাইনি, অথএব একটা মরা বাচ্চা সিজার করে কোনও লাভ নেই। এরপরেও আমি পেসেন্ট পার্টিকে বলি তাঁকে ভর্তি করতে নার্সিংহোমে যাতে কী সমস্যা সেটা দেখার জন্য। এরপর আমি নার্সিংহোমে গেলে সেখানেও আমাকে হেনস্থা করা হয়। এতকিছুর পরেও আমি পেসেন্টকে পরীক্ষা করি এবং দেখি সে রেস্টলেস হয়ে আছে। সিদ্ধান্ত নিই এটাকে সিজার করা উচিৎ। অন্তত মাকে তো বাঁচাতে হবে। এরপর সিজার করতে গিয়ে দেখি এটা ‘concealed accidental hemorrhage’। অর্থাৎ পেটের ভেতর থাকা প্লেসেন্টার পেছনে একটা রক্তপাত হয়। এই ঘটনা হাইপারটেনশনে ভোগা রোগীদেরই বেশি হয়। বা যারা বেশি কাজকর্ম করেন, ঝাঁপাঝাঁপি করেন তাঁদের বেশি হয়। যাইহোক, এতকিছুর পরেও আমি অপেরাশন করি এবং সেটা সাকশেসফুল হয়। এরপরেও পেসেন্টের জন্য কিছু জিনিস দরকার ছিল যা সেইসময়ে নার্সিংহোমে ছিল না। ফলে তাঁকে অন্য হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। সেখানে তাঁকে শুধুমাত্র একবার রক্ত দেওয়া হয়, এখন সে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে গিয়েছে। মা হওয়ার আগে বাচ্চা মারা যাওয়া একদিকে যেমন পরিবারের পক্ষে দুঃখের তেমনই ডাক্তার হিসেবে আমার কাছেও সেটা দুঃখের। কিন্তু আমি তো আর বাচ্চাটিকে পেটের ভেতরে গিয়ে মেরে ফেলিনি।’