নির্বাচন কমিশন গর্তে কার্বলিক অ্যাসিড দিয়েছে। এখন সাপ বেরোচ্ছে। ৪ তারিখে ফর্ম বিতরণের পর যে ফর্মগুলো রিটার্ন আসবে না, সেই বাংলাদেশি মুসলিমদের ডিপোর্ট করবে বিএসএফ – ২০২৫-এর ৩রা নভেম্বর অনুপ্রবেশকারীদের উদ্দেশ্যে এমনই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী।
কিন্তু এই হুঁশিয়ারি যে আদতে সত্যি হয়ে যাবে সেই আশঙ্কা করেননি অনেকেই। SIR লাগু হতেই শয়ে শয়ে নয়, হাজারে হাজারে মানুষ পালাচ্ছে ভারত ছেড়ে। অনেক বাড়িতে কিছু না বলেই কাজ ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছু পরিচারিকা। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে একাধিক গ্রাম! বাসস্ট্যান্ড হোক বা রেল স্টেশন, অনুপ্রবেশকারীদের লেগে গিয়েছে ঘর ছাড়ার হিড়িক।
অর্থাৎ, SIR শুরু হতে না হতেই, সারা বাংলা জুড়ে দেখা যাচ্ছে তার বড়সড় প্রভাব। আজ India Hood ডিকোডে আমরা তুলে ধরবো বাংলার এমন কিছু ঘটনা, যা আমার আপনার ভাবনার বাইরে, যা তুলে ধরবে বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির কথা।
বাংলায় শুরু SIR!
দিনটা ২০২৫ সালের ২৭শে অক্টোবর। বাংলায় শুরু হয় SIR-এর কাজ। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ভোটার তালিকায় মোট ৭ কোটি ৬৬ লক্ষ ভোটারের মধ্যে মাত্র ২ কোটি ৪৫ লক্ষের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সাথে মিলেছে। ৪ঠা নভেম্বর থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এনুমেরেশন ফর্ম বিতরণ শুরু করেছেন BL অফিসাররা। কিন্তু তার আগেই বঙ্গের বিভিন্ন কোণ থেকে উঠে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা! যে ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, বাংলাকে কতটা দখল করে রেখেছে অনুপ্রবেশকারীরা! আর সেই ঘটনাগুলোই এবার এক এক করে তুলে ধরবো আপনাদের কাছে।
প্রথমত, উধাও হচ্ছেন বাংলাদেশী পরিচারিকারা!
৩রা নভেম্বর সারা বাংলার বিভিন্ন মিডিয়ায় উঠে আসে এমনই এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। উত্তর ২৪ পরগণার বীরাটি, বিশারপাড়া সহ বেশ কিছু এলাকায় কিছু না জানিয়েই কাজ ছেড়ে দেয় বাড়ির পরিচারিকারা। অনেকেই হয়ে যায় রাতারাতি উধাও। আবার অনেকেই জানিয়ে যায়, আপাতত বাংলাদেশে যাচ্ছেন, পরিস্থিতি ঠিক হলে ফিরবেন আবার।
একই ছবি ধরা পড়ে কলকাতা থেকে বারাসাত, বনগাঁ থেকে হাসনাবাদ। SIR আতঙ্কে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন একাধিক পরিচারিকা। যার ফলে সমস্যায় পড়েছে একাধিক বাসিন্দা।
দ্বিতীয়ত, রাতারাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে একাধিক পরিবার!
SIR আবহে হঠাৎ করেই উধাও উত্তর দমদম পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ড ওল্ড বাকরার বেশ কিছু পরিবার। তালা ঝুলছে একের পর এক বাড়িতে। রাতারাতি তারা কোথায় গেল, কেন গেল? সেই নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। স্থানীয়দের মতে, যে সমস্ত বাড়িতে তালা ঝুলছে তাঁদের অনেকেই কাজ করেন কাগজ কুড়োনোর, অনেকেই আবার গৃহসহায়িকা। কিন্তু, এরা কেন নেই, বা কোথায় গিয়েছে সেই নিয়ে উত্তর দিতে চাননি কেউই!
তৃতীয়ত, পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে কিছু বস্তিও!
কিছু কিছু গ্রাম থেকে যেমন রাতারাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে কিছু সংখ্যক পরিবার। তেমনই আবার কোথাও কোথাও উধাও হয়ে যাচ্ছে গোটা বস্তিটাই। আর এমনই আজব কাণ্ড দেখা গিয়েছে কলকাতার নিউটাউন এলাকার মাসুদ বস্তিতে। যে বস্তি পুরোপুরি অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারাই গড়ে উঠেছিল।
আর এমনই ছবি ধরা পড়েছে নিউটাউনের বনবিবিতলা সহ ইকো পার্ক এবং দুই ২৪ পরগনার একের পর এক ঝুপড়ি-বসতিতে।
আর এর প্রমাণ প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে রেল স্টেশনে। যেখানে কাতারে-কাতারে মানুষজন ভিড় জমাচ্ছে, দেশ ছাড়ার জন্য, রাজ্য ছাড়ার জন্য!
চতুর্থত, দেশ ছাড়তে গিয়ে ধরাও পড়ছেন অনেকেই!
৩১শে অক্টোবর, SIR-এর ভয়ে পালানোর সময়ে উত্তর ২৪ পরগণার স্বরূপনগর সীমান্তে গ্রেফতার হন ১২ জন বাংলাদেশি! ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এতদিন ধরে কর্মসূত্রে থাকা এই সমস্ত বাংলাদেশিরা সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ‘পালিয়ে যাওয়া’র সময় ধরা পড়ে পুলিসের হাতে। ধৃত ১২ জনের মধ্যে ৫ জন পুরুষ, ৪ জন মহিলা ও ৩ জন শিশু। জেরায় তাঁরা জানিয়েছেন, বছর তিনেক আগে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে এসেছিলেন। এখন SIR-এর ভয়ে তাঁরা বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছিলেন।
এরপর ১লা নভেম্বর, ওই একই জায়গা অর্থাৎ উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর থানার হাকিমপুর চেকপোস্ট ও তারালি সীমান্ত থেকে সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে আরও ৪৫ জন। জেরায় জানা গিয়েছে, তাঁরা সকলেই বাংলাদেশি। এতদিন ধরে তারা ভারতের কলকাতা, রাজারহাট, নিউটাউন এবং ওদিকে দিল্লি, মুম্বই ও গুজরাট সহ বিভিন্ন রাজ্যে কর্মসূত্রে বসবাস করতেন।
২রা নভেম্বরও পশ্চিমবঙ্গের বিথারি সীমান্তে ধরা পড়ে ৩৮ জন। এর পরের দিন অর্থাৎ ৩রা নভেম্বর স্বরূপনগর থানার হাকিমপুর সীমান্তে ফের বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে চার বাংলাদেশি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মহিলা এবং শিশুও।
এখনও অবধি মোট ধরা পড়েছে প্রায় ১০০ জন।
পঞ্চমত, ভোটার তালিকা থেকেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে ভোটার!
শুনে অবাক লাগলেও, এমনই ঘটনা চোখে পড়ছে বাংলার বেশ কিছু এলাকায়। যে কারণে সমস্যায় পড়ছে বহু সাধারণ মানুষ।
মালদার মানিকচকের ধরমপুর পঞ্চায়েতের ৯৬ নম্বর বুথে, ২০০২ সালের ভোটার তালিকা থেকে হঠাৎ করেই গায়েব ৮০০ জনের নাম।
অন্যদিকে, কোচবিহারের বুথ ২ নাটাবাড়িতে দেখা যাচ্ছে ২০০২-এর তালিকায় নাম ছিল ৭১৭টি। এখন আপলোডেড লিস্টে দেখা যাচ্ছে নাম রয়েছে মাত্র ১৪০টি।
উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরেও দেখা গিয়েছে একই ছবি। ১৫৯ নম্বর বুথে এখন দেখা যাচ্ছে কোনও ভোটার নেই। কিন্তু এই বুথে ৯০০ জন ভোটার ছিল।
উত্তর ২৪ পরগনার গুমার এলাকার বুথ নম্বর ১৫৯-এর ৮৪২ জন ভোটারের নাম সম্পূর্ণভাবে উধাও হয়ে গিয়েছে! শুধু ভোটার নয়, উধাও হয়ে গিয়েছে সম্পূর্ণ বুথও। ২০০২-এর রেফারেন্স ভোটার তালিকায় এই বুথের নাম ছিল, কিন্তু SIR আপলোডের সময় সেটি হঠাৎই হারিয়ে যায়।
মাথাভাঙার ৬০ নম্বর বুথে ২০০২ সালের তালিকায় ছিল ৮৪৬ জনের নাম। কমিশনের ওয়েসবসাইটে ২০০২ সালের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ৪১৬ জনের নাম রয়েছে।
কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২০০২ সালের তালিকায় অশোকনগর বিধানসভার ৬১ নম্বর বুথের ৩৪৩ থেকে ৪১৪ নম্বর ক্রমিক সংখ্যার ভোটারের নাম নেই।
এমন ঘটনা ঘটেছে বাংলার আরও ১০০টি বুথে। যেখানে উপলব্ধ নেই ভোটারের নাম। যার মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগণা, এবং বীরভূম জেলা থেকে বেশিরভাগ ভোটারের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এই ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ২০০৩-এর তথ্য ব্যবহার করতে হচ্ছে।
এবার এটা কী কারণে হচ্ছে সেটার কোনও পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে, হতে পারে অনেকেই নিজেদের নাম কাটিয়ে বাইরে চলে গিয়েছে, অথবা হতে পারে প্রযুক্তিগত কোনও ত্রুটি! কিন্তু, এই নিয়ে কোনও তথ্য দেয়নি নির্বাচন কমিশন।
ষষ্ঠত, টাকা দিয়ে হচ্ছে SIR-এর ডকুমেন্ট!
SIR-এর জন্য যে ১২টি ডকুমেন্টের উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি উচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেট। সাধারণত অনেক সময়েই এমন হয় – পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি অর্জন করার পর অনেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট নেন না। এবার SIR-এর জন্য এমন একটি ডকুমেন্ট প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠায় অনেকেই লাইন দিয়েছে নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের মালদার গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। কারণ ছাত্রদের অধিকারের সার্টিফিকেটের জন্য পড়ুয়াদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নেওয়া হচ্ছে। একমাসের মধ্যে সার্টিফিকেট পেতে গেলে ৫০০ টাকা এবং একদিনে সার্টিফিকেট পেতে গেলে দেড় হাজার টাকা।
অন্যদিকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের পাঠানখালি গ্রামের পঞ্চায়েতে চলছে জাল জন্ম সার্টিফিকেট তৈরির কাজ। রাজ্যব্যাপী দীর্ঘ তদন্তের পর পুলিশ জানতে পেরেছে যে এই গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রায় ৪,০০০ পরিবার দুই বছরে ৩,৫০০ টিরও বেশি জাল জন্ম সার্টিফিকেট তৈরি করেছে। যার মধ্যে আবার অনেকগুলি ভারতীয় পাসপোর্ট জাল করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
সপ্তমত, কেউ কেউ ভয় টাকা তুলে নিচ্ছেন ব্যাঙ্ক থেকে!
পশ্চিমবঙ্গের ইলামবাজারের লেলেগড়ের বাঁধ পাড়া ও নিচু পাড়ার বহু মানুষ আতঙ্কে ভুগছেন। ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিচ্ছেন নিজেদের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ। তাদের আশঙ্কা – যদি এসআইআর চালু হয়, তা হলে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন জমানো অর্থ আর তোলা যাবে না। কিংবা ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম না থাকলে তাঁদের পূর্ববঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। এই আশঙ্কাতেই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন তাঁরা।
অর্থাৎ SIR এফেক্টে আপাতত কিছুটা স্তব্ধ বঙ্গ। কারণ অনেকেই রয়েছেন ভুয়ো এবং অনুপ্রবেশকারী, ফলত তারা রয়েছেন ভয়ে। অনেকেই আবার স্বার্থের জন্য অন্ধকারে রেখেছে সাধারণ মানুষকে, কেউ কেউ আবার বুক ফুলিয়ে সমর্থন করছে SIR-কে। আপনি কি SIR সমর্থন করছেন? এবং SIR-এর তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখে আপনার কেমন লাগছে?